চলো করি বিহার কোচবিহার – পর্ব ২/ চোখে পড়তেই ভালো লেগে যায় মদনমোহন মন্দির

cooch behar madanmohan
jahir raihan
জাহির রায়হান

হাঁ করা অবস্থাতেই অনুধাবন করলাম অরুণাভবাবুর পর্যবেক্ষণের সত্যতা – রাজা, মহারাজা, সম্রাট, নবাব মায় জমিদারি শাসনব্যবস্থা ছাড়া কোনো কালজয়ী স্থাপত্য নির্মাণ সম্ভব হত কিনা সন্দেহ। এ যুগে তো সম্ভবই নয়, এখন নির্মীয়মান উড়ালপুল হঠাৎ করে ভেঙে পড়ে আর ট্রেনগাড়ি নেমে আসে লাইন থেকে মাটিতে, প্রায় প্রতিদিন। গেট থেকে যতটা অংশ হেঁটে এলাম, এ রকম প্রশস্ত জায়গা থাকলে এখন আমরা বিএইচকে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি করি আর স্কোয়ার ফুটে বিক্রি করি, পাকা কলা কেজি দরে বেচার মতো। আর হ্যাঁ, সিটি সেন্টার আর মাল্টিপ্লেক্স করি গুচ্ছের, যাতে নিজেরা খাই পালটি আর টাকাকড়ি দেয় হামাগুড়ি, সারাক্ষণ। তা-ও ভালো এটা তাজমহল নয়, নইলে হয়ত শুরু হত কলরব, ওখানে ছিল দেবীর ঘর, ফিরিয়ে মন্দির, লহ বর! এখানে কী ছিল তা জানিনে, তবে যা আছে তা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ইঁট দিয়ে তৈরি ধ্রুপদী পশ্চিমী স্থাপত্যে গড়ে ওঠা দ্বিতল এক আশ্চর্য গড়ন যা উচ্চতায় ১২৪ ফুট, লম্বায় ৩৯৫ এবং ২৯৬ ফুট চওড়া। শৈলী নবজাগরণ, দরবারহল, তোষাখানা, পাঠাগার, মহিলামহল ইত্যাদি নিয়ে সে এক এলাহি কাণ্ডকারখানা। বেশ কিছু আসবাবপত্র ইতিমধ্যেই খোয়া গেছে তবুও ঘুরে ঘুরে দেখলে অনেক কিছুই দেখা যাবে। আর যদি নিজেকে টাইম মেশিনে চড়িয়ে ফেরাতে পারেন অতীতে, তা হলে তো সোনায় সোহাগা, রোম খাড়া হয়ে যাবে, গলা যাবে শুকিয়ে, মনটাও হবে উদাসী।                                 

আরও পড়ুন চলো করি বিহার কোচবিহার – পর্ব ১/ হাঁ করে দাঁড়িয়ে প্যালেসের সামনে

সমগ্র প্যালেসের অভ্যন্তর ঘুরে দেখা নিষেধ, নিষিদ্ধ ছবি তোলাও, মোবাইল ফোনটাও বন্ধ রাখা জরুরি। মন দিয়ে রাজারানিদের ব্যাপারস্যাপার আত্মস্থ করতে করতেই আপনার সময় কেটে যাওয়া নিশ্চিত, যদি না নব্য তরুণ-তরুণীদের মহলের আনাচে কানাচে, বড়ো বড়ো থামের আড়ালে-আবডালে প্রেমালাপ থুড়ি প্রেমাচার আপনার দৃশ্যদূষণ না ঘটায়। আর সেটা অসহ্য মনে হলে, বাইরে আসুন, গোটা প্যালেস চত্বরই সবুজে ছয়লাপ। দিঘিও আছে, তাতে আছে বড়ো বড়ো মাছ। অবশ্য গোটা শহর জুড়েই অনেকগুলি দিঘি খনন করা হয়েছিল সে সময়, শহরের মধ্যবর্তী সাগরদিঘি যার অন্যতম। এ দিকে সুয্যিমামা পাটে যেতে বসেছে, আলো কমে আসছে ক্রমশ। নরম আবছায়া আলোয়, কোচবিহার রাজবাড়ি বিষণ্ণতার মেঘে ক্রমশ ঢেকে ফেলছে নিজেকে। শুরু হচ্ছে আপাত রূপকের এক খেলা, যে খেলায় খেলার কুশীলবেরা কবেই অস্ত গেছে, রয়ে গেছে তাদের কায়াহীন অস্তিত্ব।                                                                      

কোচবিহার থেকে রসিকবিল যাওয়ার পরিকল্পনাটা বানচাল হয়ে গেল – রসিকবিল বন্ধ, খোলেনি এখনও। ভাবলাম তবে নেওড়া জঙ্গল ক্যাম্প যাই, রায়া রাজি হল না, পাকা পাকা গলায় বলল, পাপা জঙ্গলে যেও না, হাতি আছে, বাঘ আছে, কামড়ে দেবে। বয়স সবে চার ছাড়িয়েছে, এখনই এত বদ বুদ্ধি, নিশ্চয় ওর মায়ের কাছ থেকে পাওয়া! অগত্যা পায়ে হেঁটে শহর দেখে, বিকালে জলপাইগুড়ি ফেরাটাই স্থির হল। সাগরদিঘি এলাকাটা বেশ জমজমাট, নানান সরকারি অফিস এই অঞ্চলেই। চারিদিক বাঁধানো ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল ‘রাজবংশী ভাষা আকাদেমি’। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি জানতাম, কলকাতায় রয়েছে, এখানে তার মানে রাজবংশী ভাষা শুধু বড়ো নয়, দড় ব্যাপার। প্রসঙ্গত জানাই, এখানকার বাংলা উচ্চারণ ঠিক কলকাতা বা বাকি বাংলার মতো নয়, এখানকার উচ্চারণ পূর্ববঙ্গীয়, অসমীয়া ও রাজবংশী মিশ্রিত। সাগরদিঘির যে পাড়ে পৌর অফিস, তার সামনে থেকে ওপর দিকে তাকালে কোচবিহার প্যালেসের চূড়োটা দি্ব্যি দেখা যায়।

যে সরলরেখায় এগোচ্ছি, সেই পথেই যে মদনমোহন মন্দির তা আমি প্রায় নিশ্চিত, তবুও পথচলতি একজনের সাহায্য নেওয়া হল, জানলাম আমি ঠিকই জানি। পথপাশে একটি যুদ্ধ ট্যাঙ্ক সাজানো রয়েছে, কাছে যেতেই আস্ত এক ইতিহাসের মুখোমুখি। আমেরিকায় নির্মিত এই প্যাটন ট্যাঙ্কটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক সেনারা ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাক সেনানায়ক জেনারেল নিয়াজি-সহ ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ আর সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধজয়ের স্মারক হিসেবে প্যাটন ট্যাঙ্কটি কোচবিহারে নিয়ে আসা হয়। এটা আজকের পরম প্রাপ্তি, আগে কখনও পড়িনি এ ব্যাপারে।

রাস্তার এক দিকে বৈরাগী দিঘি ঠিক তার অপর দিকে শ্বেতশুভ্র মদনমোহন মন্দির, চোখে পড়ামাত্রই আপনার ভালো লেগে যাওয়া উচিত। গাছগাছালি ঘেরা মদনমোহন বাড়িতে মদনমোহন ছাড়াও পূজিতা হন মা কালী, মা তারা ও মা ভবানী। মেয়েকে নিয়ে মেয়ের মা দিব্যি বসে পড়ল মন্দিরের প্রশস্ত দালানে, সেখানে তখন পুজোর জোগাড় চলছিল। আর আমি একটু প্রাচীনত্বের সন্ধানে সন্ধানী চাতক, যার তৃষ্ণার সাময়িক নিবৃত্তি হল মদনমোহনের কল্যাণে। মহারাজা নরনারায়ণ ছিলেন শিবের উপাসক, শৈব। অসমের এক বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক শংকরদেবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ভগবান মদনমোহনের মূর্তি গড়ে এক পবিত্র পূর্ণিমায় তার প্রতিষ্ঠা করেন। রাধা বিনা মদনমোহনের উপস্থিতি ওই শংকরদেবের অনুপ্রেরণার ফসল। এর পর ১৮৮৭ সালে কোচ সিংহাসনে আরোহণের পর, ব্রাহ্মমতে দীক্ষিত মহারানি সুনীতি দেবীর উৎসাহদানে মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ মন্দিরের অবস্থান পরিবর্তনে সচেষ্ট হন। তারই ফলশ্রুতিতে ২১ মার্চ ১৮৯০ সালে সাড়ম্বর ও জাঁকজমকপৃর্ণ শোভাযাত্রা-সহ রাজমাতা নিশিময়ী দেবী বর্তমান মদনমোহন মন্দিরের উদ্বোধন করেন। আগত ভক্তবৃন্দের রাত্রিবাসের সুবিধার্থে আনন্দময়ী ধর্মশালার পত্তন করেন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ। যেখানে আপনিও রাত্রিযাপন করতে পারেন সামান্য খরচের বিনিময়ে, আজও।

মন্দিরের মূল গৃহে ব্রোঞ্জনির্মিত চৌদলাতে রয়েছে দু’টি বিগ্রহ – বড়ো মদনমোহন ও ছোটো মদনমোহন। যদিও আগত দর্শনার্থীরা শুধু বড়ো মদনমোহনেরই দর্শন পান, ছোটো মদনমোহন পর্দার আড়ালেই থাকেন, বছরে তিন দিন তাঁর দেখা মেলে। মন্দির চত্বরের পূর্ব দিকে মা ভবানীর আলাদা মন্দির অবস্থিত, সেখানে মা ভবানীর অপরূপ রূপ আামায় অনাবিল ভাবে আকর্ষণ করল, এত নিখুঁত বিগ্রহ ইতিপূর্বে আমি দেখিনি কখনও। পূর্বে শহরের ভবানী মার্কেটে মা ভবানী থাকতেন, মদনমোহন বাড়ি নির্মাণের পর এখানেই তাঁকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। কোচবিহারের মদনমোহন মন্দির-সহ মোট ২৯টি মন্দিরের দেখাশোনা করে এখানকার দেবত্র ট্রাস্ট বোর্ড। এ ছাড়াও উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে দু’টি এবং বৃন্দাবনে আরও একটি রাজসম্পত্তির ভার বোর্ডের ওপর। (চলবে)

ছবি: লেখক                                                         

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *