চলো করি বিহার কোচবিহার – শেষ পর্ব / নাগাল পেলাম খেয়ালি তোর্সার

river torsa
jahir raihan
জাহির রায়হান

এতদূর এসে রাসমেলা প্রাঙ্গণ না দেখলে ধম্মে সইবে না আবার রায়াকে আইসক্রিম না খাওয়ালে বড়ো অধর্ম হবে, ফলত ধর্ম ধরে রাখার স্বার্থে দু’টো কাজই করা হল। কোচবিহার রাসমেলা সমগ্র উত্তরবঙ্গের সব চেয়ে বড়ো, প্রায় দু’শো বছরের প্রাচীন সম্প্রীতির উৎসব। রাসপূর্ণিমার দিন শুরু হয়ে এই মেলা চলে পরবর্তী পূর্ণিমা অবধি। রাজবাড়ি-সহ গোটা কোচবিহার শহর সেজে ওঠে, আনন্দে মেতে ওঠে শহরবাসী ও অগণিত ভক্তের দল, ওই দিনগুলিতে। মদনমোহন মন্দির চত্বরে নির্মিত হয় প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার রাসচক্র যা পরম্পরাগত ভাবে সাজিয়ে তোলেন এক মুসলিম পরিবার, যদিও রাস মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব। কিন্তু কাতারে কাতারে আগত দর্শনার্থী বছরের পর বছর এখানে প্রমাণ করে চলেছেন উৎসবের কোনো আমরা-ওরা থাকতে নেই, জীবন যার, উৎসবটাও তারই, সব ধর্মের, সব বর্ণের। ভক্তকুল পুণ্য ও আশিসের আশায় ওই রাসচক্রটি নিজহাতে ঘোরান যা নাকি বৌদ্ধ প্রথার সংস্কার। রাধাকৃষ্ণের মৃত্তিকা মূর্তি ও ভগবান কৃষ্ণের জীবনের নানাবিধ কর্মকাণ্ড নিয়ে বেরোয় বর্ণাঢ্য রাসযাত্রা, যা এই উৎসবের মূল আকর্ষণ। যদিও রাসমেলা প্রাঙ্গণে এই মূহূর্তে তার কোনো হদিস পাওয়া গেল না।

শহর পরিক্রমা শেষ অঙ্কে, হঠাৎই মনে এল জেনকিন্স স্কুলের কথা। মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলপ্রকাশের পর প্রায় প্রতি বৎসরই সংবাদপত্রে লিপিবদ্ধ থাকে এই স্কুলের নাম। অতএব যেতে হবে, সকাল থেকে মা-মেয়েকে এতই হাঁটিয়েছি যে বলতে সাহস হল না আর। তা ছাড়া স্কুলের আবার কী দেখবে? এটা যদি বলে ফেলে তা হলে তো ঘোর বিপদ। কাজেই বললাম, তোমরা একটু বসো, আমি আসছি। যুগযুগান্ত থেকে রমনীকণ্ঠে ধেয়ে আসা প্রশ্নবাণ, আমাকেও করল বিদ্ধ, কোথায় যাচ্ছ? কতক্ষণ লাগবে? পাত্তা দিলাম না, মোড় হতে পোড়ামাটির লালরঙের বাড়িগুলি নজর করতেই পাওয়া গেল জেনকিন্স। শুনেছি আমাদের সবার প্রিয় রবি ঘোষ ছিলেন এই বিদ্যালয়েরই ছাত্র। জানা গেল মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণ এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। শহরবাসীকে আধুনিক শিক্ষায়, বিশেষ করে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্যই ছিল তাঁর এই উদ্যোগ। মেজর জেনারেল ফ্রান্সিস জেনকিন্স ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী। পরবর্তীতে তিনি বাংলার বড়লাটের সরকারি প্রতিনিধি এবং অসমের কমিশনার পদে নিযুক্ত হন। তিনি অসম, কোচবিহার ও পূর্বাঞ্চলের লোকেদের প্রতি ছিলেন বিশেষ অনুরাগী। শোনা যায়, অবসরের পরও ইংল্যান্ড না ফিরে তিনি অসমেই রয়ে যান। ১৮৬৬ সালে তাঁর মৃত্যুর সময়ও এতদঞ্চলে কোনো হাইস্কুল ছিল না। তার পরই মহারাজার এই প্রয়াস যা এখন রাজ্যের অন্যতম একটি সরকারি বিদ্যালয়। দেড়শো বছর অতিক্রম করা স্কুলভবনটির গঠন, স্থাপত্য ও পরিবেশ দেখলে আমি নিশ্চিত, আপনারও আবার ছাত্রজীবন ফিরে পেতে ইচ্ছে জাগবে।

আরও পড়ুন চলো করি বিহার কোচবিহার – পর্ব ১/ হাঁ করে দাঁড়িয়ে প্যালেসের সামনে

হোটেল ‘মাছে ভাতে বাঙালি’তে এ যাত্রায় শেষ বারের মতো, পেট পুজোর তাগিদে। দিন দুই কোচবিহারে ঘোরাঘুরির সূত্রে জানলুম, এরা হোটেলে সরু চাল ব্যবহার করে। সরু চালের প্রতি আমার প্রেম পরকীয়ার ন্যায়, ফলে কোচবিহারের পাইস হোটেলগুলি আমার কাছে দশে দশ। ক্ষুন্নিবৃত্তি তো হল, কিন্তু হাতে যে বেশ কিছুটা সময় রয়ে গেল এখনও, কী করা যায়? সহধর্মিনী এখন বিদ্রোহিণী, যা-ই করো আমি আর হাঁটতে পারব না, বলে দিল সকপটে। অগত্যা টো টো কোম্পানি হয়ে গেল টোটোর সওয়ারি। মনে করে দেখুন, তিস্তাকে মনে মনে যতটা প্রেম দেন, তোর্সাকে কিন্তু দেন না, এবং এটা মোটেই উচিত কাজ নয়। তিস্তা ছাড়া তো্র্সাকে নিয়েও আমরা কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে মন কষাকষি করতে পারি লাগাতার। যাক গে, সে পরে হবে ক্ষণ, এখন আমরা তোর্সা-পথের যাত্রী।

আরও পড়ুন চলো করি বিহার কোচবিহার – পর্ব ২/ চোখে পড়তেই ভালো লেগে যায় মদনমোহন মন্দির

নদীর মহা সুবিধে হল একটি দেশে জন্ম নিয়ে দু’তিনটি দেশ অনায়াসে ভ্রমণ করতে পারে, কোনো ভিসা পাসপোর্ট ছাড়াই। তোর্সার কথাই ধরুন, জন্ম চিনের চুম্বি ভ্যালিতে, তার পর ভূটান, ভারত হয়ে দিব্যি সে চলে গেছে বাংলাদেশ। পথিমধ্যে কয়েক বার নাম বদল করতে হয়েছে এই যা। সে নামবদল তো আমিও করে থাকি বারংবার, দেবদেবী দর্শন করতে গিয়ে জাহির রায়হান হয়ে যায় বাপী সেন, অথবা অচেনা নম্বর থেকে নারীকণ্ঠ শোনা গেলে, আলাপচারিতায় নিজের নাম না নিয়ে, বন্ধুবান্ধব বা কোনো কাল্পনিক নাম বলে দিই অবলীলায়, ওতে কোনো দোষ নেই। ভাঙাচোরা কাঠের একটা সাঁকো পার হয়েই নদীর নাগাল পাওয়া গেল। চওড়া, বিস্তৃত তোর্সা নিজের খেয়ালে রয়ে চলেছে, দূরে একটা ব্রিজ দেখা যাচ্ছে যার ওপর দিয়েই কোচবিহার শহরে প্রবেশ করেছি সম্ভবত। বেশ কয়েকটা ছবি পটাপট তুলে ফেললুম, প্রথমে ব্রিজের, তার পর বউয়ের, সব শেষে তোর্সার জলরাশির। গানও আসছিল মনে…ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…। আরতিতে শুরু, হেমন্তে শেষ, বললাম না মানুষটা আমি একটু সেকেলে ধরনের, ব্যাকডেটেড। (শেষ)

One Reply to “চলো করি বিহার কোচবিহার – শেষ পর্ব / নাগাল পেলাম খেয়ালি তোর্সার”

  1. খুব ভালো লাগলো। যাওয়ার আগে জেনে নিলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *