ওড়িশার দারিংবাড়িতে কি সত্যিই বরফ পড়ে?

শ্রয়ণ সেন

শুরু হয়েছিল সেপ্টেম্বরেই। সময়ের বরফে ঢেকে গিয়েছিল হিমাচলের লাহুল-স্পিতি। তার পর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। তুষারপাতে ঢেকে গেল কেদার-বদরী। ডিসেম্বরের শুরুতেই বরফ পড়ল শিমলায়। গত দশ বছরে বড়োদিনের এত আগে বরফ দেখেনি শিমলা। এর কিছু দিনের মধ্যেই দার্জিলিং, সিকিম, ভুটান। ‘ফেটাই’-এর প্রভাবে প্রবল তুষারপাত হল সান্দাকফুতে। সাদা হয়ে গেল ছাঙ্গু হ্রদ। বরফের আনন্দে একদিনের ছুটি ঘোষণা করল ভুটান সরকার। সময়ের আগেই এ বার বরফ পাচ্ছে হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চল।

স্বভাবতই অনেক মানুষের মধ্যেই প্রশ্ন জেগেছে, ওড়িশার দারিংবাড়িতে কি এ বার তুষারপাত হবে? সোশ্যাল মিডিয়ায় কান পাতলেই দেখা যাচ্ছে, অনেক মানুষের প্রশ্ন। দারিংবাড়িতে বরফ পড়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন তাঁরা।

এ রকম পোস্টই ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

দারিংবাড়ি। সমুদ্রতল থেকে তিন হাজারের ফুটের কিছু বেশি উচ্চতায় অবস্থিত এই জায়গাটি ওড়িশার কাশ্মীর হিসেবে পরিচিত। ইদানীং পর্যটকদের, আরও পরিষ্কার করে বললে, বাঙালি পর্যটকদের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই দারিংবাড়ি।

দক্ষিণ ওড়িশার কন্ধমল জেলায় অবস্থিত এই শৈলশহর। একটা সময় ছিল, যখন মাওবাদীদের দাপট ছিল এই অঞ্চলে। তাই ওড়িশা পর্যটনের একটা পান্থনিবাস থাকলেও, ধীরে ধীরে পর্যটকের অভাবে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তার পর মাওবাদীদের দাপট কমলে আবার দারিংবাড়ির রমরমা। এ বার আরও জোরদার। দারিংবাড়িকে পর্যটনের মানচিত্রে নিয়ে আসার জন্য অনিল সোয়েনের অবদানও কম কিছু নয়। তিনিই এখানে ইকো হোম তৈরি করেন। দারিংবাড়ি জনপদের একটু বাইরে অবস্থিত এই ইকো হোম থেকে সামনের উপত্যকাটি বেশ লাগে। পর্যটক সমাগম বাড়তে শুরু করায় এখন আরও দু’একটি হোটেল তৈরি হয়েছে বাজার সংলগ্ন এলাকায়। ওড়িশা ইকো ট্যুরিজম দফতরও একটি সুন্দর রিসোর্ট তৈরি করেছে এখানে।

সুতরাং এ সব থেকেই বোঝা যায় দারিংবাড়ি ঠিক কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

এ বার আসা যাক মূল বক্তব্যে। দারিংবাড়িতে সত্যিই বরফ পড়ে? সেই সত্যিটা উদ্ঘাটন করার জন্য এটি লেখা। ব্যাপারটা এ বার বিশ্লেষণ করা যাক।

দারিংবাড়ির ইকো হোম থেকে।

প্রথমেই বলা যাক দারিংবাড়িতে তুষারপাত হয় না। অতীতে কোনো দিনই দারিংবাড়িতে বরফ পড়েনি, আর ভবিষ্যতেও পড়বে না। তা হলে বরফ পড়ার প্রসঙ্গ আসছে কেন?

এটা স্রেফ সংবাদমাধ্যমের একটা অংশের তৈরি করে দেওয়া বিভ্রান্তি। যে বিভ্রান্তিতে সওয়ার হয়ে সাধারণ পর্যটকও বিশ্বাস করেন এখানে বরফ পড়ে।

দারিংবাড়িতে তুষারপাত হয় না, কিন্তু শীতকালে মাঝেমধ্যে যেটা হয় তা হল গ্রাউন্ড ফ্রস্ট। অর্থাৎ, প্রবল ঠান্ডায় রাতে পড়া শিশিরই ভোরের দিকে জমে বরফ হয়ে যায়। ভোরবেলায় সাধারণ মানুষ ঘুম থেকে উঠেই খেলায় করেন মাঠঘাটে সাদা বরফের একটা আস্তরণ তৈরি হয়ে গিয়েছে। প্রতি বছরই এই ঘটনাটি ঘটে। এ বছর জানুয়ারির ২৭-২৮ তারিখেও এমন ভাবেই বরফের আস্তরণ দেখা গিয়েছিল।

গ্রাউন্ড ফ্রস্ট এবং তুষারপাতের মধ্যে পার্থক্য কী?

তুষারপাত হতে গেলে প্রাথমিক ভাবে যেটা দরকার তা হল মেঘ এবং বৃষ্টি। বৃষ্টির পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে, কোনো ভাবেই তুষারপাত হবে না। অন্য দিকে গ্রাউন্ড ফ্রস্টের জন্য দরকার পরিষ্কার আকাশ, জম্পেশ ঠান্ডা।

এ ভাবেই গাছের ওপরে পড়া শিশির জমে বরফ হয়ে যায় দারিংবাড়িতে।

বেসরকারি আবহাওয়া সংস্থা ওয়েদার আল্টিমার কর্ণধার রবীন্দ্র গোয়েঙ্কা বলেন, উত্তর এবং মধ্য ভারত যখন প্রবল শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়ে, তার প্রভাব আসে দারিংবাড়ির ওপরেও। তাঁর কথায়, “ডিসেম্বরের শেষ দিক থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দারিংবাড়ির সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি চলে যাওয়া কোনো ভাবেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ মধ্য ভারতের প্রবল ঠান্ডার প্রভাব পড়ে দারিংবাড়ি এবং সমগ্র কন্ধমল জেলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে।” সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্যর কাছাকাছি চলে গেলেই দেখা দেবে গ্রাউন্ড ফ্রস্ট।

কখনও যদি শীতে দারিংবাড়িতে বৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা হলে কোনো ভাবেই সেখানে তুষারপাত হবে না। কারণ তুষারপাত হতে গেলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রাকে পৌঁছে যেতে হবে শূন্যের কাছে আর দারিংবাড়িতে শীতে বৃষ্টি হলে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা কমবে তো না-ই, বরং অনেকটাই বেড়ে যাবে। কারণ বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প ঢুকবে এই অঞ্চলের ওপরে।

উচ্চতাজনিত কারণ

কখনও শুনেছেন রুদ্রপ্রয়াগে বরফ পড়ছে? রুদ্রপ্রয়াগ এবং দারিংবাড়ির উচ্চতা কিন্তু প্রায় একই রকম। হিমালয়ের কোলে অবস্থান করা রুদ্রপ্রয়াগেই যদি বরফ না পড়ে, তা হলে দারিংবাড়িতে বরফ পড়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবীন্দ্রবাবু বলেছেন, “দারিংবাড়ি এক হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত হলেও নিরক্ষরেখার অনেকটাই কাছে। ফলে এখানে ক্রান্তীয় বা গ্রীষ্মপ্রধান আবহাওয়ার প্রাধান্যই বেশি। সুতরাং কোনো ভাবেই এখানে তুষারপাত সম্ভব নয়।”

দারিংবাড়ির ইকো হোমের কটেজগুলি।

তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? দারিংবাড়িতে তুষারপাত হয় না। কিন্তু মাঝেমধ্যে গ্রাউন্ড ফ্রস্ট দেখা দেয়। তাই তুষারপাতের আকাঙ্খায় দারিংবাড়ি গেলে ব্যর্থ হবেন। কিন্তু আপনার ভাগ্য যদি অত্যন্ত ভালো হয়, তা হলে কড়া শীতের কোনো এক ভোরে দেখবেন আপনার ঘরের বাইরে শিশির জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। এটাই দারিংবাড়ির সৌন্দর্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *