শান্তিনিকেতনের পথে বড়ার চৌমাথায় মণ্ডার স্বাদ নিন

IMG_7247

শম্ভু সেন

সাত সকালেই বড়ার চৌমাথায় দিলীপ ঘোষের মণ্ডার দোকানে বেশ ভিড়। আপাতত আমাদের গন্তব্য শান্তিনিকেতন হয়ে নানুর। ফেরার পথে এক বার ঢুঁ মারব।

দিলীপবাবুর মণ্ডার সঙ্গে আমার পরিচয় বছর তিনেক আগে। সে বারেও ফিরছিলাম শান্তিনিকেতন থেকে। গুসকরা পেরিয়ে আসার পর চায়ের তেষ্টাটা জোরদার চেপে বসল। বড়ার চৌমাথায় বর্ধমানমুখী রাস্তার বাঁ দিকে পেয়ে গেলাম দিলীপ ঘোষের দোকান। চায়ের সঙ্গে ‘টা’ হিসাবে সিঙাড়ার সঙ্গে নিয়েছিলাম মণ্ডা। কিছুটা অনুরোধে পড়ে। লোকে তো উপরোধে ঢেঁকিও গেলে। আসলে দিলীপবাবুর দোকানের অন্য ক্রেতারাই জোর করেছিলেন মণ্ডা পরখ করে দেখার জন্য। বেশ ভয়ে ভয়েই চেখেছিলাম। কারণ বীরভূম-বর্ধমান-বাঁকুড়ার অতি আদরের মণ্ডা খাওয়ার ‘সৌভাগ্য’ আগে অনেক বার হয়েছে। মূলত চিনির পাক, ছানা আছে কি নেই, বোঝা যায় না। কিন্তু দিলীপবাবুর মণ্ডা ? বুঝলাম অন্য জিনিস।

মণ্ডা-মিঠাই একটা বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ। সামগ্রিক ভাবেই মিষ্টান্ন শ্রেণিকেই বোঝাত। কালক্রমে মণ্ডা ও মিঠাই দু’টি বিশেষ শ্রেণির মিষ্টান্নে পরিণত হয়। ছোলা বা মুগের বেসন থেকে তৈরি ঘিয়ে ভাজা ছোট ছোট দানাকে (যাকে চলতি কথায় বোঁদে বলে) চিনি বা গুড়ের রসে পাক করে পরে গোল করে বাঁধাই করা যে মিষ্টি তাকেই সাধারণ ভাবে বলা হয় মিঠাই। পরে যা থেকে জন্ম হয়েছে ‘দরবেশ’-এর। আর মণ্ডা কথাটি সম্ভবত ‘মণ্ড’ থেকে এসেছে। চিনি বা শর্করাকে পাক করে পাওয়া যায় যে মণ্ড তার থেকে তৈরি মিষ্টি হল মণ্ডা। মূলত চিনির গোলাকার মিষ্টান্নকেই মণ্ডা বলা হত। এ ধরনের মিষ্টির মধ্যে পড়ে চিনির বিস্কুট বা নবাত, বাতাসা, কদমা, চিনির মুড়কি। দেবভোগ্য মিষ্টান্ন হিসাবে প্রাচীনকালে এই মণ্ডার চল ছিল। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগেও মিঠাই ও মণ্ডার কদর ছিল খুব বেশি। গ্রামবাংলায় পাড়ায় পাড়ায় নবজাতকের জন্মের খবর হলেই মাটির সরায় ভরে মিঠাই ও মণ্ডা বিতরণ করা হত দোরে দোরে। আজও দেবদেবীর নিত্যনৈমিত্তিক সেবায় এই মণ্ডা চালু থাকলেও সামগ্রিক ভাবে মণ্ডার আর সে দিন নেই। এখন মণ্ডা বললেই একটা নাক-সিঁটকানো ভাব। এটা আবার মিষ্টি নাকি ! কিন্তু দিলীপের মণ্ডার জাতই আলাদা।

কর্ণধার দিলীপ ঘোষ
কর্ণধার দিলীপ ঘোষ

তাই তিন বছর পরে ফের যখন এ রাস্তায় পা পড়ল, তখনই মনে পড়ে গেল দিলীপ ঘোষের মণ্ডার কথা। জিটি রোড দিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে রাজবাটী, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরকে রেখে ডান দিকে গাড়ি ঘুরল। বর্ধমানের বিখ্যাত ১০৮ শিবমন্দির পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলল। সিউড়ি রোড। এ রাস্তার চেহারা-চরিত্র এখন বেশ ভালো। তাই শান্তিনিকেতন বা বীরভূমের অন্যত্র যেতে হলে এখন আর খুব একটা কেউ পানাগড়-ইলামবাজারের পথ ধরেন না। চলেন সিউড়ি রোড হয়ে। আমরাও সেই পথের শরিক। আসা-যাওয়া, দু’ বেলাতেই।

ফেরার পথে সন্ধে নেমেছে বোলপুর ছাড়াতেই। তাই যখন গুসকরা পেরিয়ে গেলাম, আঁধার বেশ ঘনই। এগিয়ে চলেছি। লক্ষ্য, বড়ার চারমাথায় দিলীপ ঘোষের ‘অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। বেশ কয়েকটা চৌমাথা পেরোলাম, কিন্তু বড়া আর আসে না। পেরিয়ে এলাম নাকি! অন্ধকারে হয়তো ঠাহর করতে পারিনি। মনকে প্রবোধ দিই, এ বার আর মণ্ডা চাখা হল না। আশা যখন হতাশার পথ ধরেছে, ঠিক তখনই আলোআঁধারিতে নজরে পড়ে গেল ‘অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’।

DSCN0263

তিন বছর আগে এই দোকানেই মণ্ডার স্বাদ পেয়েছিলাম, দিলীপবাবুকে এ কথা জানাতেই রীতিমতো খাতির জুড়ে দিলেন। সেই সঙ্গে দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা অন্য খদ্দেররাও।

৩৫ বছর ধরে এই ব্যবসা চালাচ্ছেন দিলীপ ঘোষ। মণ্ডার সঙ্গে এখানে পাওয়া যায় ল্যাংচা, রাজভোগ ইত্যাদি মিষ্টি। কিন্তু তাঁর ‘স্পেশাল মণ্ডা’র কদরই সব চেয়ে বেশি। এর খ্যাতি এখন কলকাতাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। “যাঁরা এই পথে নিয়মিত কলকাতা যাতায়াত করেন, তাঁরা আমার মণ্ডার বড়ো খদ্দের। তাঁদের দৌলতেই হয়তো কলকাতা থেকে অর্ডার আসে” – বেশ গর্বভরে বললেন দিলীপবাবু।

কিন্তু মণ্ডা বললেই তো আমরা নাক সিঁটকাই। সন্দেশের কাছে তো পাত্তাই পায় না। অনেকে আবার চিনির ডেলা বলে হতছেদ্ধা করে। তাঁর মণ্ডার এত খ্যাতি কেন ?

“আমার মণ্ডার সঙ্গে সন্দেশের তফাৎ সামান্যই। সন্দেশে ১ কেজি ছানায় ৩০০ গ্রাম চিনি লাগে। আর আমার মণ্ডায় ১ কেজি ছানায় ৫০০ গ্রাম চিনি থাকে। আর সাধারণত মণ্ডা বলতে আমরা যা বুঝি তাতে ছানা আর চিনির ভাগ সমান সমান। এর পর কারিগরের হাত তো আছেই। তাঁর হাতের পাকের ওপরেও নির্ভর করে মণ্ডার স্বাদ” –- দিলীপবাবুর জবাব।

কথায় কথায় আমাদের মণ্ডা প্যাক হয়ে গিয়েছে। “এ তো নিচ্ছেন বাড়ির জন্য। এখানে বসে একটু স্বাদ নিয়ে যান” – দিলীপবাবুর নির্দেশে আমাদের জন্য চলে এল সব থেকে বড় সাইজের গরম মণ্ডা আর চা। বলা বাহুল্য, এর জন্য দাম নিলেন না দিলীপবাবু।

“৩৫ বছর আগে শুরু করেছিলাম ছোট্ট একটা চালাঘর দিয়ে। নিজেই বানাতাম মণ্ডা। আজ দোকান বড়ো হয়েছে। কারিগর রাখতে হয়েছে। বিয়ে-শাদির মরশুমে অর্ডার সাপ্লাই দিতে হিমশিম খেয়ে যাই। সবই আপনাদের আশীর্বাদে” -– দিলীপবাবুর নমস্কারের বিনিময়ে প্রতিনমস্কার করলাম।

বর্ধমান থেকে শান্তিনিকেতন বা বীরভূমের অন্য কোথাও যাতায়াতের পথে অন্তত একবারটি চলুন সিউড়ি রোড ধরে। বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির থেকে ৯-১০ কিমি বড়া। গুসকরার আগেই বড়ার চৌমাথায় ‘অন্নপূর্ণা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের’ মণ্ডার স্বাদ নিন। পশ্চিমবঙ্গের এক প্রাচীন মিষ্টি। ঠকবেন না, এটুকু গ্যারান্টি রইল।



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *