কৃত্তিবাস ও গোঁসাইবাড়ির শান্তিপুর : প্রথম পর্ব

জাহির রায়হান

পিন্টুদার সাথে আমার প্রথম আলাপ ছন্নছাড়া মেসে। ব্যাঙ্ককর্মী শিবশংকর দাস ওরফে পিন্টু আদতে চিত্রকর, দুর্দান্ত ছবি আঁকে আর পেটের জ্বালা মিটিয়ে চাকরিটা দুম করে কেন ছেড়ে দিতে পারে না তাই নিয়ে হা-হুতাশ করে প্রায়শই। আঁকাজোকা ছাড়াও নানান বিষয়ে তার আগ্রহ এবং উদ্দীপনা অপরিসীম। নানান বিষয় মানে এই হিসেবি আমরা যেগুলিকে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো বলে মনে করি আর-কি, যেমন নাটক, ফটোগ্রাফি চর্চা, স্মারক বক্তৃতা, পত্রিকা প্রকাশ, বহুমুখী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি। পিন্টুদা আবার বনের সব মোষকে তাড়িয়ে ঘরে ভরতে ভীষণই উৎসাহী, যে ঘরে জামাকাপড়ের চেয়ে বইপত্র বেশি এবং রয়েছে সর্বংসহা বৌদি। শান্তিপুরের পিন্টুদা যখন বেলডাঙায় থাকত চাকরিসূত্রে, তখন এক সন্ধ্যায় হিমাচলের সারখুন্ডি পাস ট্রেক করার আমার প্রস্তাবে স্রেফ এক মিনিটে রাজি হয়েছিল, সেই থেকে তাকে আমি ভালবাসি। এমন বল্‌গাহীন লোকের সচরাচর দেখা মেলে না। তবে এখানে আপনাদের হিমাচলের গল্প শোনাচ্ছি না, সেটা বরং অন্য দিনের জন্য তোলা থাক, আজ শোনাই অন্য কথা।

বেশ কিছু দিন ধরেই ফোন করে পিন্টুদা আমাকে সমানে খুঁচিয়ে চলেছে, জাহির শান্তিপুর এসো, এখানে কিন্তু অনেক কিছু দেখার আছে। এমনিতে রাজারহাট-নিউটাউন আর শান্তিপুরের অবস্থান কোনোমতেই আয়ত্তে আনতে পারি না, সেটা নিয়ে নিজমনেই একটা খামোখা খেদ টের পাই। তার ওপর শীতটাও করছে পালাই পালাই। তো যাওয়াই যায়, কিন্তু সমস্যাটা হল আমার বিয়ে করা সবেধন নীলমণি একমাত্তর বউ আবার রাত্রে একা থাকতে মানে আমায় ছেড়ে থাকতে পারে না। আমি না থাকলে গোটা দুনিয়াটা আসলে বিছানাটা নাকি তার কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এটা অতিপ্রেম না আমাকে আটকে রাখার সতেরো নং সিঙ্গাপুরী কলা, সেটা নিয়ে আমি গবেষণা চালাচ্ছি নিয়ত, ফলাফল পরে আপনাদের জানিয়ে দেওয়া হবে। বউকে যদি বা করায়ত্ত করা যায়, বেটি আবার আরও সরেস, পাকা পাকা গলায় এমন ভাবে জেরা শুরূ করবে যে আমার পরিস্থিতি তখন শ্যাম রাখি না রাখি কুল। এ হেন জরুরি অবস্থা বাঁচিয়ে পিন্টুদাকে কথা দিলাম, তাই হবে, শনিবার সন্ধ্যায় যাব শান্তিপুর।

নামার কথা শ্যামচাঁদ, নামলাম মোতিগঞ্জ মোড়ে, কারণ বাসটা যাবে কালনা ঘাটের দিকে। এ দিকে পিন্টুদার ফোন বন্ধ, ল্যান্ডফোন তো বহু আগেই ঘরছাড়া। আগে একবার এসেছি তার বাড়ি প্রায় এক দশক পূর্বে, ফলে রাস্তা চিনে যে সেথা যেতে পারব না সে ব্যাপারে সুনিশ্চিত। রাতও হয়েছে অনেকখানি আর কেমন যেন মনে হল, আমার দেখা বাকি পৌরশহরগুলির তুলনায় রাস্তায় আলোও কিছুটা কম। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই দাদার সাড়া পাওয়া গেল এবং তার নির্দেশিত পথে শুরু হল হন্টন। ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব যে এককালে ছিল শহরে তার প্রমাণ মিলল কিছুটা এগিয়েই, চোখে পড়ল শান্তিপুর ব্রাহ্মসমাজ। রথতলা পৌঁছে দেখি একটি সুউচ্চ রথের ধাতব কাঠামো দণ্ডায়মান পরের বছরের অপেক্ষায়। তবে আমায় অপেক্ষা করতে হল না বেশিক্ষণ, মুখভর্তি সাদা দাড়ি নিয়ে বাইক-বাহনে হাজির শিবশংকর দাস।

krittibas well
কৃত্তিবাস কূপ।

বাড়ির নাম ‘রবিবার’। গেট খুলতেই অসংখ্য শ্বেতগোলাপ সপরিবার ব্যস্ত আমারই অভ্যর্থনায়। অভ্যর্থনায় কার্পণ্য নেই বৌদিরও। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির আমার মতো আরও তিন বেবাক বাউন্ডুলে। তেলভাজা মুড়ি, চা আর নানান কথামালা ও আড্ডায় আসর সরগরম। রাত দশটার পর রসভঙ্গ করে বাকিরা বিদায় নিলেও, আমাদের দু’জনার বকবকানি চলতেই থাকে। এক সময় বৌদি বকা দেয়, আগে খেয়ে নাও, তার পর ওপরে গিয়ে গল্প করোগে, রাত হয়েছে। এমন রমণী না থাকলে বাড়ি যে কখনও ঘর হয়ে উঠতে পারে না সেটা জানান দিয়ে গেল আমার অনুভূতি। অগত্যা খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ হল, রাত প্রায় একটা অবধি নানা রঙের গল্পগুজবের শেষে ক্ষেপণাস্ত্রটা নিক্ষেপ করলাম – তা তো হল দাদা, কিন্তু তোমার আঁকাআঁকি কত দূর এগোল, এখন তো বাড়ির কাছেই তোমার চাষ ও বাস, তবে? যথারীতি পিন্টুদা বলল, পেনশন চালু হওয়ার কথা চলছে জানো তো। ওটা চালু হলেই আমি স্বেচ্ছাবসর নিয়ে পুরোপুরি আঁকায় মন দেব। আর এই নানান ব্যাপারে জড়িয়ে পড়াটা আমার ঠিক হচ্ছে না একদম বুঝলে, সব ছেড়ে দেব’খন। পাঠক, আপনার জানার কথা নয়, এই একই উত্তর প্রায় পনেরো বছর আগে সে দিয়েছিল আমায়। গত দেড় দশকে আকাদেমি আর শান্তিপুরে গোটা কয়েক প্রদর্শনী করা ছাড়া পুরোপুরি আঁকায় মগ্ন হতে পারেনি চিত্রকর, শিল্পীরা বুঝি এমনই হয়।

সকাল সকাল উঠে প্রথমেই পৌঁছে গেলাম বাঙালি রামের আঁতুড়ঘরে। বাংলার আদি কবি কৃত্তিবাসের খাগের কলমেই মূর্ত হয়ে ওঠে বাল্মীকির রাম। বাঙালি অবতারে, সংস্কৃত রামায়ণের ভাবানুবাদে রচিত হয় কৃত্তিবাসী রামায়ণ। একটি বৃহৎ বটবৃক্ষের ছায়ায় বসে, বহতা গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে কৃত্তিবাসের এই মহাকাব্যিক প্রচেষ্টা। বটবৃক্ষ এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, রয়েছে কৃত্তিবাস কূপও, তবে গঙ্গা কিছুটা দূরে গেছে সরে, যদিও নিকটস্থ ঘাটটি কৃত্তিবাস ঘাট নামে পেয়েছে পরিচিতি। বয়ড়া শ্রীশ্রীহরিপাটে সমাধিস্থ রয়েছে আদি কবির অস্থি। তার ঠিক পাশেই ‘কৃত্তিবাস মেমোরিয়াল লাইব্রেরি কাম মিউজিয়াম’, যেখানে দেখা যাবে কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণের আসল পাণ্ডুলিপির প্রতিচ্ছবি, মূল পাণ্ডুলিপিটি কোনো ভাবে হাতবদল হতে হতে পৌঁছে গেছে সুদূর ফ্রান্সে। এই ঐতিহাসিক কর্মটি দেশে ফেরানোর দাবি জানাই।

shyamchand jiu temple
শ্যামচাঁদ জিউ মন্দির।

রাধা শ্যামচাঁদ জিউ বিশ্বের বৃহত্তম আটচালা মন্দির। টেরাকোটার কাজ ও তার পরিবেশ দু’টোই মনোহরণ করে। বড়ো নাটমন্দির, আমগাছের ছায়া এবং সদ্য ফোটা আমের মুকুল-মঞ্জরীর সুবাস জুড়ায় প্রাণ। শোনা যায়, উদ্বোধক কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় হাতি চেপে এসেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠাতা জমিদার রামগোপাল খাঁ চৌধুরী হাতির প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা নজরানা দিয়েছিলেন মহারাজকে। শান্তিপুরের জমিদারেরা ‘খাঁ’ উপাধি পান বক্তিয়ার খিলজির কাছে, বাংলা আক্রমণ করতে আসেন তিনি নদীপথে। যে ঘাট ব্যবহার করে তিনি জমিদারিতে পা রাখেন তা এখনও বক্তিয়ার ঘাট নামে পরিচিত, ঘোড়ালিয়ায় রাখা হয়েছিল ঘোড়াসহ সৈন্যসামন্তদের। জমিদারদের অতিথিপরায়ণতায় খুশি হয়ে তিনি প্রদান করেন খাঁ উপাধি।

বেরোনোর সময় মাংস, আলু ও পেঁয়াজ নেওয়ার কথা বলে দিয়েছিল বৌদি, বাজারে ঢুকে বৌয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল চিত্রশিল্পী। বাজার শেষ হলে জানাল, প্রতিটা পুরোনো শহরেই একটি ‘প্রস এরিয়া’ আছে, যেমন বেনারস, বৃন্দাবন। আমাদের শান্তিপুরেও রয়েছে, যাবে নাকি একবার? এটা আমি জানতাম, জানতাম সেই বয়স থেকেই যখন নিষিদ্ধ ছায়াছবির প্রতি ছিল আমার দুর্নিবার আকর্ষণ। তবে কী কারণে পুরোনো শহরে এর অবস্থান তা জানতাম না। পিন্টুদা জানাল, এটা মূলত বাবু-সংস্কৃতির অঙ্গ। সহধর্মিনীরা অন্তঃসত্ত্বা হলে, বাবুদের রতিবিলাসে যাতে অসুবিধা না হয় তারই জন্য এর পত্তন। বাবু-সংস্কৃতির অবসান হলেও, মানুষের প্রবৃত্তি শেষ হয়নি, তাই এরা রয়ে গেছে। এখন মূলত লরির চালক ও খালাসিদের এ চত্বরে আনাগোনা, তবে রাসের সময় কিছু বহিরাগতও আসে বই-কি। যাবে ? উত্তরে বললাম, যাওয়া যেতেই পারে। রেলপথে কলকাতা যাওয়ার সময় দেখেছি, ব্যারাকপুর-টিটাগড়ের মাঝামাঝি এলাকায় বহু রমণীই মুখ ঢেকে বসে থাকে, মনে মনেই বলি তাদের, মা তোমাদের নয়, লজ্জা তো আমাদেরই পাওয়া উচিত, আমরাই তো তোমাদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে পারিনি। আজ মনে হল, ওরা তো তাও সৎ, খেটে খায়, অন্তত নীরব বা সরব মোদী তো নয়! (চলবে)

কী ভাবে যাবেন

শিয়ালদহ থেকে সরাসরি ট্রেন, ধর্মতলা থেকে বাস চলে শান্তিপুর। আবার হাওড়া থেকে ট্রেন ধরলে গুপ্তিপাড়া বা কালনা নেমে ভাগীরথী পেরিয়েও আসা যায় শান্তিপুর। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে কলকাতা থেকে শান্তিপুর ৯৬ কিমি, গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যায়, পথ বারাসত-চাকদা-রানাঘাট-ফুলিয়া হয়ে।

কোথায় থাকবেন

থাকার জন্য পৌরসভার অতিথি নিবাস রয়েছে, ফোন-০৩৪৭২-২৭৮০১৮, ২৭৭৪০১। এ ছাড়াও শহরের মোতিগঞ্জ এলাকায় বেশ কিছু বাজেট হোটেল আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *