রানাঘাটের যে স্বাদ ভোলা যায় না

Lancha
payel samanta
পায়েল সামন্ত

চুর্ণী নদী, জয় গোস্বামী আর রাখি গুলজারের রানাঘাটে এলে পান্তুয়া না খেয়ে ফেরা আর তারাপীঠে গিয়ে মা তারার দর্শন না করা সমান অপরাধের!

আমাদের টোটোচালক বছর বাইশের ফটিকের এই উক্তি শুনে চমকে গিয়েছিলাম। ও বলল বলেই তো চুর্ণী নদী দেখে ফেরার পথে সাইনবোর্ডহীন একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকলাম পান্তুয়া খেতে। একটা বড়ো কড়াইয়ে রসশয্যায় শায়িত পান্তুয়াদের দল আমাকে ইশারাতে ডাকল। এই মিষ্টির দোকানের খুব কাছেই রানাঘাটের আদি জমিদার পালচৌধুরীদের বাড়ি। ফটিক ফিসফিস করে বলল, “আজকের পালচৌধুরীরাও এই দোকান থেকে পান্তুয়া কেনে! কলকাতাতেও যায় এদের পান্তুয়া। পান্তুয়া কি কলকাতায় তৈরি হয় না?  তবু রানাঘাট পান্তুয়া এ ব্যাপারে এক নম্বর। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই তা প্রবাদপ্রতিম। কেন জানেন, জিআই মানে জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিটি।  যেমন একটা গান আছে না, আছে গৌরনিতাই নদিয়াতে, কৃষ্ণ আছে মথুরাতে, কালীঘাটে….। ওটাই জিআই। কৃষ্ণনগরের সরভাজা-সরপুরিয়া, রানাঘাটের পান্তুয়া, বাংলাদেশের ইলিশ।…”

ফটিক আরও কী সব বলে যাচ্ছিল, কিন্তু কানে কিছুই ঢুকছিল না। মুখে তখন পান্তুয়া। কী স্বাদ! মনে হল, কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকে এই অপরিবর্তিত স্বাদই কি জন্ম দিয়েছে কিংবদন্তি পান্তুয়ার? যে রেসিপির হাতে লেগে আছে রানাঘাটের অগণিত নাম-না-জানা হালুইকরের ব্র্যান্ড ইকুয়িটি।

ব্র্যান্ডের কথাই যদি বলি, ফটিকের মতে, জগু ময়রা ওরফে যজ্ঞেশ্বর প্রামাণিকের একচ্ছত্র রাজত্ব রানাঘাটে। মানে প্রায় একশো বছর আগে রানাঘাটে তাঁর মহান হাত ধরেই দোকানে পান্তুয়ার আবির্ভাব হয়। তাঁরই বংশ পরম্পরায় ধরে রানাঘাটে পান্তুয়ার মোঘল সাম্রাজ্য চলে আসছে। প্রভাত প্রামাণিকের হাতে ১৯২০ সাল নাগাদ পান্তুয়ার স্বর্ণযুগ এল। যেন শাজাহানের আমল। জগু ময়রার দোকান এখনও আছে। জগু ময়রার উত্তরাধিকারীরা আজ এলাকায় মেজদা সেজদা ছোড়দা (যেন পান্তুয়া সাম্রাজ্যের ‘ডন’) নামে পরিচিত।

sweet shop in ranaghatশহর জুড়েই প্রচুর মিষ্টির দোকান। দত্তফুলিয়া, রথতলার একগুচ্ছ মিষ্টির দোকানের সবেতেই পান্তুয়া মজুত। সুজি, ছানা, ক্ষীর, ঘি, নকুলদানা দিয়ে তো পৃথিবীর সকলেই পান্তুয়া বানায়। তবে রানাঘাটের পান্তুয়ার রহস্য কী? তারা মা মিষ্টান্ন ভান্ডারের সুনীল কুণ্ডু প্রায় রহস্য করে জানালেন, এই উপকরণ দিয়ে তো ল্যাংচা, লালমোহন, লেডিকেনি, নিখুঁতি, গুলাবজামুন প্রায় সবই তৈরি হয়! তবে শক্তিগড়ের ল্যাংচা যেমন বর্ধমানের নয়, ঠিক যে রকম রানাঘাটের পান্তুয়া আবার পুরো নদে জেলার নয়। তেমনি ভীম নাগের লেডিকেনি আবার রানাঘাটের পান্তুয়া নয়।

মাছ আর মাছরাঙা বা বর আর বরকন্দাজ যেমন এক নয়, এ তো অনেক ছোটোবেলাতেই জেনেছি। পান্তুয়া আর লেডিকেনিও এক হবে না। কিন্তু পান্তুয়ার রহস্য ভেদ তো হল না! বরং ভেবে দেখলাম, বিতর্কিত বিষয় বটে! পান্তুয়া গুলাবজামুন নাকি গুলাবজামুন পান্তুয়া?

সিদ্ধেশ্বরী সুইটস্-এ দেখা হল মিষ্টিরসিক তাপস দে-র সঙ্গে। তিনি বললেন, “পান্তুয়াতে বেশি খোয়াক্ষীর থাকে। আসলে কড়াইতে পান্তুয়া ভাজার উপরই নির্ভর করে স্বভাবটা কেমন হবে। রানাঘাটের পান্তুয়া একটু বেশিই ভাজা হয়। উপরের লালচে পুরু আবরণটা বেশ শক্ত। ওটাই কায়দা! এখনকার কারিগরেরা অবশ্য পুরনো ঐতিহ্য মেনেই পান্তুয়া তৈরি করে চলেছে।”

আরও পড়ুন: শান্তিনিকেতনের পথে বড়ার চৌমাথায় মণ্ডার স্বাদ নিন

রানাঘাটের পান্তুয়ার স্বভাব যা-ই হোক না কেন, আকারটা ঠিক আমাদের কলকাতার চেনা গোল গোল আকৃতির নয়। আবার শক্তিগড়ের ল্যাংচাসুলভ লম্বাটেও নয়। বলা ভালো, লম্বাটে ধাঁচের, দেখতে মাকু আকৃতির বললে খুব অবিচার হবে না। আবার মুখে দিলে একটা পুরু আবরণীতে কামড় পড়বে। এমনিতে অবাঙালিরা আমাদের কলকাতার পান্তুয়াকে গুলাবজামুন বলতে পারলেও রানাঘাটের পান্তুয়া তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য এ সবের থেকে স্বতন্ত্র।

লোকনাথ সুইটসের নিয়মিত খদ্দের বিশ্বজিৎ দেবনাথ জানালেন, “এখনকার পান্তুয়া আকারে ছোটো হচ্ছে। সেই কোয়ালিটিও নেই। তার পর দামও বাড়ছে উত্তরোত্তর। সে যা-ই হোক, তা বলে পান্তুয়া খাওয়া ছাড়তে পারা যাচ্ছে না। মুখে দিলে ও-সব আর মাথায় থাকে না।”

খুব পুরোনো শহর রানাঘাট। মন্দিরের সঙ্গে গির্জাও যেমন আছে, তেমনি প্রাচীনের পাশে নতুনেরও সহাবস্থান এখানে। কিন্তু মিষ্টির দোকানে নতুন মিষ্টির আগে ঠাঁই পায় কুলীন পান্তুয়া। এক কালে পুরো ঘি দিয়ে ভাজা হত পান্তুয়া। এখন অবশ্য ঘি ব্যবহার করা হয় না। ছানার কোয়ালিটিও আগের মতো নেই। তাতেই প্রতি পিস ৫ টাকা, আবার ১০ টাকাও আছে।

পান্তুয়া সাম্রাজ্যের এক করুণ ইতিহাসও শুনে নিলাম রানাঘাট স্টেশন চত্বরে। সারা শহরে হরিদাস পালের অভাবটা নাকি পূরণ হচ্ছে না! কে এই হরিদাস পাল? পান্তুয়া টাইকুন নাকি বিখ্যাত কারিগর? রানাঘাট স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মের বাইরে নিজের দোকান করেছিলেন হরিদাস পাল। পান্তুয়ার এমন স্বাদ যেন এলাকার মানুষের মুখে লেগে আজও। বছর ত্রিশ হল সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শোনা যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সন্ধ্যা রায় এখানে পান্তুয়া খেয়েছেন। হরিদাস পালের পরিপূরক নাকি আজও হয়নি। এই শহরে কত দোকান! তবুও একটা বিশেষ দোকানের কথা বলা হলে বোঝা যায়, সত্যিই তা কালজয়ী বটে! পান্তুয়া খেয়ে-খাইয়ে এবং বেঁধে নিয়ে মনে হল, পান্তুয়ার জিআই স্বীকৃতি নিয়ে রানাঘাট মুখর হবে কবে?

রসগোল্লা নিয়ে এখন যখন বাংলা আর ওড়িশার মধ্যে ধুন্ধুমার চলছে তখন রানাঘাটে বসে শুনলাম, হারাধন ময়রার কথা। তিনি পালচৌধুরীদের জন্য কাজ করতেন। উনিশ শতকে চিনির রসে তাঁর হাত থেকে কিছু ছানার গোল্লা পড়ে যায়। আর তাই নাকি হয়ে যায় রসগোল্লা! এ সব ক’জন জানেন? নবীন ময়রা, কেসি দাসকে যত লোক চেনেন, তাঁরা সবাই কি হারাধন ময়রাকে চেনেন? তাই তো জিআই দরকার পান্তুয়ারও! হাজার বছর পরে পান্তুয়ার জন্মরহস্য নিয়ে কথা উঠলে ওটাই হবে গাছকোষ্ঠি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *