চলুন ঘুরে আসি: পাখিপাহাড়

dancing peacock, pakhipahar
মৌ মুখোপাধ্যায়

‘পিন্দারে পলাশের বন….’ – গানটা শুনলেই পুরুলিয়ার কথা মনে পড়ে যায়। এই পলাশের টানেই গত মার্চ মাসে দু’দিনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম পুরুলিয়া ভ্রমণে। গাড়ি নিয়ে পুরুলিয়ার আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলাম ‘পাখি পাহাড়ে’। নামটি শুনে মনে হয়েছিল হয়তো বা অনেক পরিযায়ী পাখির দেখা মিলবে। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম একটি অনুচ্চ পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য উড্ডীয়মান পাখির প্রতিচ্ছবি আঁকা। বেশির ভাগ পর্যটক পাহাড়টি দূর থেকে দেখে ফিরে যান। আমরা ব্যাপারটা আরও ভালো করে বোঝার জন্য এগোতেই স্থানীয় একজন অনু্রোধ করলেন পাহাড়টির কাছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। শাল-সেগুনের পাতার মর্মরধবনি ভেঙে এগিয়ে যেতে পাথরের গায়ে খোদাই করা কিছু মূর্তি চোখে পড়ল। হঠাৎ পিছন থেকে গুরু গম্ভীর সম্ভাষণ –  “এ দিকে আসুন”। খানিকটা ভয় আর কৌতূহল নিয়ে ভদ্রলোকের কাছে পৌঁছোলাম। পরিচিত হলাম ভাস্কর্যশিল্পী চিত্ত দে মহাশয়ের সঙ্গে।

sculptor cjitta dey
শিল্পী চিত্ত দে।

বিগত ৩০ বছর ধরে শিল্পী এই পাহাড়ে ‘ইন-সিটু রক স্কাল্পচার’-এর কাজ করছেন। সাধারণত ভাস্কর্যশিল্পীরা বাছাই করা পাথর তুলে স্টুডিওতে নিয়ে এসে সেই পাথর কেটে মেলে ধরেন নিজের শিল্পকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পাথরটিকে যথাস্থানে রেখেই তাতে কিছু খোদাই করা হয়, ঠিক যেমনটা আমরা অজন্তায় দেখতে পাই। ১৯৯১ সালে কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এর একটি প্রদর্শনীতে চিত্ত দে-র তৈরি ধাতব পাতের উপর খোদাই করা ২২ ফুটের ডানা মেলা একটি পাখির মূর্তি ঢুকতে বাধা পায়। বাধ্য হয়ে শিল্পী চিত্ত দে ডানাগুলি ক্লিপ দিয়ে পাখিটিকে ছোটো করে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেন। তখন অনেকেই বলেছিলেন যে পাখিটি আরও ছোটো করা উচিত ছিল। কিন্তু শিল্পী তার প্রতিবাদে জানান, তিনি তাঁর কল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেছেন মাত্র। এই শহরের আর্ট গ্যালারিতে সেই কল্পনাকে জায়গা দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে তিনি অন্য জায়গা খুঁজে নেবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা, মহারাষ্ট্রের পশ্চিমঘাট পর্বতের বিভিন্ন স্থানে, বিহার ও ওড়িশার নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান ও কোন পাথরে তিনি তাঁর শিল্পকে ফুটিয়ে তুলতে পারবেন সেটা বোঝার জন্য ওই সব অঞ্চল থেকে পাথরের কিছু নমুনা সংগ্রহ করে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে পরীক্ষার জন্য পাঠান।

sculpturing going on
চলছে খোদাইয়ের কাজ।

অবশেষে ১৯৯৬ সালে পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডিতে কাজ করার অনুমতি পেলেও ১৯৯৭ সালে মাত্র দু’ লক্ষ টাকার সরকারি আর্থিক অনুদানে কাজ শুরু করেন। সরকারি অনুদানের সঙ্গে তাঁকে অনুরোধ করা হয় কিছু শহুরে ভাস্কর্যশিল্পীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার জন্য। শিল্পী চিত্ত দে তাতে রাজি না হয়ে স্থানীয় আদিবাসী লোকেদের সঙ্গে কাজ করার উপর জোর দেন। প্রথম চার বছর ধরে ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করলেও অবশেষে ২৪ জনকে নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে কাজ শুরু করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় এনামেল রং ব্যবহার করে ছবিগুলো আঁকেন। রং-এর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে খোদাইয়ের গভীরতার সংকেত। ছেনি-হাতুড়ি সম্বল করে খোদাইয়ের কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে ৬৫টি ডানামেলা পাখির ভাস্কর্য খোদাই করেন। যার সব চেয়ে ছোটো ডানার দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট আর সব চেয়ে বড়ো ডানার দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট। প্রথমে পাহাড়টির নাম ‘মুরা বুরু’(উচ্চতা ৮০০ ফুট) থাকলেও ধীরে ধীরে পাহাড়টি ‘পাখি পাহাড়’ নামে পরিচিতি পায়। যদিও ওঁর লক্ষ্য ১০০টি পাখির প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা।

miniature bird
পাখির মিনিয়েচার।

প্রশ্ন করলাম – ‘পাখি কেন?’ উত্তরে তিনি জানালেন, তাঁর আদি বাড়ি টাকি। একদিন সন্ধ্যাবেলায় তিনি একশোর বেশি পাখিকে একসঙ্গে একই ছন্দে উড়ে যেতে দেখেন। একই তালে ও ছন্দে উড়ন্ত দলবদ্ধ পাখিরা ওঁকে বিশেষ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী আরও সরকারি অনুদান পেয়ে কাজটি এগিয়ে নিয়ে যান। হাতে পান আধুনিক কিছু যন্ত্রপাতি, ড্রিল মেশিন, সুরক্ষার জন্য হেলমেট। এই পাহাড়ে বছরের তিন–চার মাস কাজ করা সম্ভব হয়। তীব্র গরমে ও বর্ষায় তিনি কাজ বন্ধ রাখেন। সে সময় তিনি বাংলা ও আশেপাশের রাজ্যের জেলকয়েদিদের প্রশিক্ষণ দেন। এখনও পর্যন্ত তিনি ২০০-এর বেশি জেলকয়েদিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এ ছাড়াও ২০১৫ সালে পাখিপাহাড়ের অনতিদূরে ‘আয়না’ নামক একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করেন। এই ভাবে তিনি এ কাজে আদিবাসীদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

বর্তমানে উনি পাথরের উপর কখনও হরিণের পরিবার, ফুল, সুনামির হাত থেকে রক্ষা পেতে তীরে উঠে আসা কচ্ছপের দল ইত্যাদি ফুটিয়ে তুলছেন। এ ছাড়াও ‘নৃত্যরত ময়ূরের’ ছবি শেষ করেছেন। জানলাম, খোদাইয়ের কাজ পরের দিন থেকে শুরু হবে। আমরা যেখানে প্রকৃতিকে ধবংস করার কাজে মাতি সেখানে এক শিল্পী ছেনি-হাতুড়ির সাহায্যে প্রকৃতি রক্ষায় ব্রতী। সপ্তাহান্তে অবশ্যই ঘুরে আসুন প্রকৃতির পাথুরে ক্যানভাসে গড়ে ওঠা এই সুন্দর ‘পাখি পাহাড়ে’।

pakhipahar
পাখিপাহাড়।
কী ভাবে যাবেন

সাঁতরাগাছি থেকে রূপসী বাংলা/হাওড়া থেকে লালমাটি এক্সপ্রেস, রাঁচি ইন্টার সিটি বা চক্রধরপুর এক্সপ্রেস ধরে চলে যান পুরুলিয়া স্টেশনে, সেখান থেকে একদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে আসুন পাখি পাহাড়।

কোথায় থাকবেন

পুরুলিয়ায় থাকার অনেক বেসরকারি হোটেল আছে। উল্লেখযোগ্য হোটেল আকাশ সরোবর (০৩২৫২-২২৪৪৮৮/২২৩৩৭৭/২২৩৩৮৫, ওয়েবসাইট www.akashsarovar.com), পুষ্পক হোটেল (০৩২৫২-২২২০৮০), হোটেল পুরুলিয়া ইন (০৯৭৩৫৪৯৫৭৫৪, ওয়েবসাইট https://hotelpuruliainn.com)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *