তারাপীঠকে ‘বুড়ি’ করে

tarapith
papiya mitra
পাপিয়া মিত্র

তারাপীঠ অনেকেই যান। আর পাঁচ জনের মতো আমরা যখন রামপুরহাট স্টেশনে নামলাম তখন চাঁদিফাটা ঝলসানি বুঝিয়ে দিচ্ছিল তীর্থস্থানের কী মহিমা। স্টেশনের ট্রেকার-অটো আর টোটোর ধাক্কা সামলিয়ে দু’টি পরিবারের সঙ্গে একটি বড়ো গাড়িতে পৌঁছোলাম তারাপীঠ মন্দিরের গলির মুখে।

মায়ের মন্দিরের কয়েক পা আগে আমাদের ঠিক করা হোটেল ‘মায়ের দান’ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ভদ্র-নম্র যুবক হোটেল ম্যানেজার সুব্রত মণ্ডল আমাদের জন্য নির্ধারিত ঘরে পৌঁছে দিয়ে এলেন। আহা কোথায় এলাম। মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম আমাদের কলকাতার বন্ধুকে এমন ঘর পাইয়ে দেওয়ার জন্য। বারান্দার দরজা খুলতেই জীবিত কুণ্ড আর তার গা ঘেঁষে মায়ের মন্দির। সন্ধ্যারতি শুনতে পাব এই ভেবেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল। তবে সন্ধের অপেক্ষা করতে হল না। বিকেলেই মন্দিরে গিয়ে জায়গা নিয়ে বসে পড়লাম। কী অপূর্ব পরিবেশ। আন্দাজ করতে অসুবিধে হল না ভোরে ঘুম ভাঙবে মায়ের আরতির ছন্দে।

temple of tarama
তারামায়ের মন্দির।

সন্ধ্যারতি দেখে পূর্ব পরিচিত পলাশবাবুর দোকানে আড্ডায় বসলাম। পলাশবরণ চট্টোপাধ্যায়। সকলেই চেনে পলাশদার দোকান। তার আগে এক চক্র ঘুরে নিয়েছি মন্দির প্রাঙ্গণ। তারামায়ের ভৈরব চন্দ্রচূড় শিবের মন্দির দর্শন করে এসেছি। নানা কথায় উঠে এল মায়ের বিশ্রামকক্ষের কথা। শুনছিলাম ভাদ্র, কার্তিক ও পৌষ অমাবস্যায় বিশেষ পুজো হয়। এখানে মেলা বসে। আর আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে মূল মন্দির থেকে মাকে বের করে এনে রাখা হয় বিরামঘরে। নাটমন্দিরের ডান দিকে একটু উঁচুতে সেটি। সকলেই যাতে দর্শন পায়। তিন-চার দিনের একটা ছোট্ট ছুটি মায়ের কাছে কাটাব বলে এসেছি। তারাপীঠ ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানা দর্শনীয় স্থান। দোকানে বসে চপমুড়ি খাচ্ছিল শানু। অটোচালক। মিষ্টি, ভদ্র ছেলেটি যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। ও-ই বলে দিল কোথায় কোথায় যাওয়া যেতে পারে।

আরও পড়ুন জলসাঘরের করুণ সুরে নিমতিতা রাজবাড়ি

 

পরের দিন শানুর অটো চলল বীরচক্রপুরের একচক্রগ্রামে। এখানে ‘নিতাইবাড়ি’ ঘিরে আরও মন্দির গড়ে উঠেছে। প্রথমে গেলাম বাঁকারায়ের অন্তর্ধানস্থল ‘জানুকুণ্ড’ বা ‘হাঁটুগাড়া’ আশ্রম। প্রভু নিত্যানন্দ স্নানের জন্য মায়ের ইচ্ছে পুরণের জন্য সব তীর্থ থেকে জল এনে এই কুণ্ডের সৃষ্টি করেন। কথিত এই কুণ্ডে সপ্তসাগর ও সপ্তনদী বিদ্যমান। কয়েক পা দূরে, ন’চূড়ার মন্দিরে শ্রীগুরু শ্রীগৌর ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মন্দির। মন্দির ঘিরে গড়ে উঠেছে আশ্রম। এখান থেকে গন্তব্য হল পঞ্চপাণ্ডবতলা। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের স্থান। আছে মাতাকুন্তী সহ পাঁচপুত্র ও ব্যাসদেবের মূর্তি ও শ্রীকৃষ্ণের মন্দির, যা ছোটো বৃন্দাবন নামে পরিচিত। রামনবমী ও দোলে মহা উৎসব পালিত হয়। তারাপীঠ থেকে সাঁইথিয়ামুখী ১০ কিলোমিটার দূরত্বে বলরামের অবতাররূপী নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর জন্মস্থান গর্ভাবাস নামে প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবতীর্থ বীরচন্দ্রপুর। এখানে আছে নিতাইয়ের আসল জন্মস্থান সূতিকামন্দির, ষষ্ঠীতলা, বিশ্বরূপতলা, সন্ন্যাসীতলা ও মালাতলা। শ্রীক্ষেত্রের দেবতা জগন্নাথদেবের মন্দির। কিছু দূরে ইস্কনের সুদৃশ্য মন্দির। সেখানকার সাফাইকর্মী বেণু পাল মন্দিরের নিয়মকানুন জানিয়ে দিলেন। আগে থেকে জানিয়ে দিলে তিনশো টাকায় থাকার সুযোগ মেলে। অর্থের বিনিময়ে ভোগ (৫০), রাতের খাবার (৪০) ও জলখাবার (৩০) পাওয়া যায়। ছায়াঘেরা শান্ত পরিবেশ সহজেই মন কেড়ে নিল।

sutika mandir
বীরচন্দ্রপুরের সূতিকা মন্দির।

শুনেছি সাধক বামাক্ষ্যামার জন্মস্থান এখানেই। তাই এ বার আটলার পথ ধরা। তারাপীঠ থেকে সোজা পথ ধরলে মাত্র ৪ কিলোমিটার। মসৃণ রাস্তার দু’ধারে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা। শানু তার বাবার মুখের শোনা কথা বলতে লাগল। আগে এই রাস্তা ছিল একবারে মাটির। আর বর্ষাকালে অবস্থা আরও খারাপ। তবুও মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। পায়ে হেঁটে মানুষের যাতায়াত ছিল। রাস্তা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। ২৬ কাটা জমিতে গড়ে উঠেছে বামাক্ষ্যাপার মন্দির ও কালীমায়ের মন্দির। এখানেই তাঁর জন্মভিটের মূল চালাটি রেখে নির্মাণ হয়েছে মন্দির। ফিরে এসে তারামায়ের নাটমন্দিরে বিশ্রাম। আমাদের পূজারি পলাশদার কাছে আবদার ছিল মায়ের অন্নভোগ খাওয়ার। মায়ের আশিসে তা মিলেও গেল। নাটমন্দিরে বসিয়ে নিজের হাতে পরিবেশন করে তবে তিনি গেলেন বিশ্রামে। আমাদের জানা ছিল না, এই ভোগ কিনতেও পাওয়া যায়। আর আমিষ ভোগ খেতে গেলে আগে থেকে জানাতে হয়। টিকিট করতে হয়। তবে সবটাই মায়ের কৃপা। কী ছিল না সেই ভোগে। পোলাও, আলুভাজা, সিমভাজা, বেগুনভাজা, ফুলকপি ও বাঁধাকপির তরকারি, ভেটকিমাছের ঝাল, টমেটোর চাটনি ও পায়েস।

দুপুরে হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে এলাম মায়ের আরতি দেখতে। আগে যখন এসেছিলাম তখনকার থেকে এখন ব্যবস্থা অনেক সুশৃঙ্খল। প্রত্যেক ভক্ত যাতে আরতি দেখতে পান তার খেয়াল রাখছে মন্দির নিরাপত্তা কর্মীরা। এ দিকে বাইরেও জায়েন্ট স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে মন্দিরের ভিতরের অংশ। আরতি শেষে পলাশদার দোকানে এ বার আড্ডা তেলেভাজা মুড়ি নিয়ে। আমাদের পরের দিনের সূচি ঠিক হল ভদ্রপুরে আকালীপুরের গুহ্যকালী, নলহাটেশ্বরী, মুলুটিগ্রামের মৌলাক্ষীমায়ের কাছে যাওয়ার।

gujhjhyakali of akalipur
আকালীপুরের গুহ্যকালী।

বাবু দাস আমাদের চার চাকার সারথি। ভোরের হাওয়ায় আমরা আকালীপুরের দিকে রওনা দিলাম। তারাপীঠ থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটারের পথ ভদ্রপুর। রাজা নন্দকুমারের জন্মস্থান। ভদ্রপুর বাসস্ট্যাণ্ডের ডান দিকে আকালীপুরের দেবী আকালীর মন্দির। আটকোণা গর্ভগৃহে মহারাজ নন্দকুমারের স্বপ্নে পাওয়া দেবী কালীর মূর্তিতে বৈচিত্র্য আছে। এখানে দেবী সর্পাসনা, সর্পাভরনা, বরাভয়দায়িনী দ্বিভূজা। শ্মশানবাসিনী শ্রীশ্রীগুহ্যকালীকার মূর্তি কষ্টিপাথরের। মন্দিরটি নির্মাণের সময় উত্তর দিকের দেওয়ালটি বিদীর্ণ হয়। আজও সেই ফাটল সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আটকোণা মন্দিরের চূড়াতেও উত্থিত ফণাযুক্ত সর্পালংকৃত। ব্রাহ্মণী নদীর তীরে শ্মশান ঘেঁষে এই মন্দির। ওয়ারেন হেস্টিংসের অসাধুতার প্রতিবাদ করায় মন্দিরটির অসম্পূর্ণ অবস্থায় ফাঁসি হয় নন্দকুমারের। কথিত, মগধরাজ জরাসন্ধের পূজিত দেবীকে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলায় আনেন উত্তর ভারত থেকে। প্রাথমিক সখ্যতার সুবাদে সেই মূর্তি পান নন্দকুমার।

আরও পড়ুন এক টুকরো ইতিহাস – বাণগড়

এখান থেকে ১২ কিলোমিটার পথে নলহাটেশ্বরী। এই অঞ্চল থেকে ১৪ কিলোমিটার রামপুরহাট ও ১০ কিলোমিটার তারাপীঠ। অনুচ্চ টিলার ঢালে দেবীপার্বতী বা নলহাটেশ্বরী মন্দিরের জন্য নলহাটি বিখ্যাত। বিষ্ণুচক্রে খণ্ডিত দেবীর কন্ঠহাড় এখানে পড়ায় তাই পীঠে পরিণত হয়েছে। দ্বিমতে নলক বা নলা বা নুলো অর্থাৎ কনুইয়ের হাড় পড়ে এখানে। ভোর ৪টেয় তাকে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করানো হয়। এবং তা স্পর্শ করা যায় তখন। চারচালা মন্দিরে লাল কাপড়ে আচ্ছাদিত সিঁদুর মাখানো পাথরে রুপোর চোখ-নাক-মুখ বসিয়ে দেবীরূপে পূজিত হন। শোনা যায়, ২৫২ বঙ্গাব্দে স্বপ্নাদেশে কামদেবের আবিষ্কার। মন্দির গড়েন নাটোরের রানি ভবানী। মন্দিরের ডান দিকে আছে বিঘ্ননাশক গণেশমন্দির ও সিঁড়িপথে আছেন দেবীর ভৈরব যোগেশ্বরের মন্দির। মন্দিরের পিছনে টিলারের আকারে বর্গিযুদ্ধে শহিদ পীর কেবলা আনাশাহী মাজার শরিফ। শান্ত-স্নিগ্ধ ছায়াঘেরা পরিবেশ। দুপুরের আহারের জন্য রামপুরহাটে ফিরে এলাম।

temple ma moulakhhi
মা মৌলাক্ষীর মন্দির।

ঝাড়খণ্ডের মুলোটি গ্রামে মা মৌলাক্ষীর মন্দির। রামপুরহাট-দুমকা বাসে ১২ কিলোমিটার গিয়ে সুঁড়িচুয়ার মোড় থেকে বাঁ দিকে আরও ৪ কিলোমিটার পথ। আমরা চলেছি গাড়িতে। খর রোদে আর অসাধারণ নৈঃশব্দতা চিরে বাবু দাসের গাড়ি ছুটছিল। জনমানবহীন পরিবেশে ভয় যে একবারে পাইনি তা নয়। তবুও দেখে আসি মৌলাক্ষী মাকে। বাংলা-বিহার সীমান্তে শক্তি-সাধকদের তন্ত্রভূমি দুমকার গুপ্তকালী মুলোটি বা মালুটি বা মল্লহাটি গ্রাম। এখানে দেবীর মন্দির ছাড়াও চোখশান্তি করা টেরাকোটার কাজ করা ৭২টি শিবমন্দির আছে। ছিল ১০৮টি। অবক্ষয়ের পথে যা অবশিষ্ট। প্রতি মন্দিরে শিবলিঙ্গ বর্তমান। এক একটি মন্দিরে টেরাকোটার কাজ দিয়ে পৌরাণিক আখ্যান চিত্রিত।

মৌলাক্ষী মন্দিরে যখন পৌঁছোলাম তখন মধ্যদুপুর পার হয়ে গিয়েছে। আশপাশে ছিলেন পুরোহিত। আমাদের ঘোরাঘুরি দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন কিছু কথাও মন্দির নিয়ে। রাজা রাক্ষসচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির। এই মায়ের কাছে এসে প্রথম সাধনা করেন বামাক্ষ্যাপা। পরে তারাপীঠে যান ও মন্দিরের কাছে বিস্তৃত শ্মশানই সাধনক্ষেত্র রূপে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। আগেই লিখেছি আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে মূল মন্দির থেকে মাকে বের করে এনে রাখা হয় বিরামঘরে। তখন তারামায়ের মুখ এই মৌলাক্ষী মায়ের মন্দিরের দিকে ফেরানো থাকে। জানা গেল, ইনি বড়মা। তারামা ছোট। এখানে আগে পুজো-বলিদান শুরু হলে তার পরে শুরু হয় তারাপীঠের পুজো। দ্বারকা নদের এ-পার ও-পার।

কী ভাবে যাবেন

হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে রামপুরহাট। সেখান থেকে অটোয় তারাপীঠ। তারাপীঠ রোড স্টেশনে নেমেও যেতে পারেন। তবে সব ট্রেন তারাপীঠ রোডে থামে না। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in

সড়কপথে কলকাতা থেকে দূরত্ব ২২৩ কিমি, পথ জাতীয় সড়ক ১৯ (পূর্বতন জাতীয় সড়ক ২, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে) হয়ে বর্ধমান, তার পর জাতীয় সড়ক ১১৪ বরাবর গুসকরা, শান্তিনিকেতন, সাঁইথিয়া হয়ে তারাপীঠ।

কোথায় থাকবেন

তারাপীঠে থাকার জন্য প্রচুর বেসরকারি হোটেল ও লজ আছে। আগাম সংরক্ষণের দরকার হয় না। তবু যদি চান খোঁজ পাবেন makemytrip, goibibo, trivago, cleartrip ইত্যাদি ওয়েবসাইট থেকে।

ছবি : লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *