চেনা বৃত্তের বাইরে: ফুটফুটে ফুটিয়ারি

সঞ্জয় গোস্বামী

সুন্দরী কলাবনি আর লধুড়কার মাঝে ফুটিয়ারির রূপকথা। আপন খেয়ালে বয়ে চলা ফুটিয়ারি নদীর ছন্দ কাটে ফুটিয়ারির ড্যামে, তিন দিক থেকে চলে শাসন তিন পাহাড়ের – তিলাবনি, পাঞ্জোনিয়া, সিন্দুরপুর – এই ত্রয়ীর কড়া অনুশাসনে ফুটিয়ারি গেঁথে চলে রূপকথা।

বেশ কিছু দিন ধরেই দিব্যেন্দুদা বলছিলেন, “দাদা, একবার সময় করে আসুন, দেখে যান।”  কিন্তু পরিস্থিতির চাপে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ একদিন মনোস্থির করেই ফেললাম। ক’ দিন ধরেই পুরুলিয়া টানছিল, তাই চাকা ছুটল।

কাশের আগমনীবার্তা রাস্তার ধারে, শরতের নীল আকাশ আর রাঙামাটির মনে দোলা দেওয়া ল্যান্ডস্কেপ – এ নিয়েই গাড়ি ছুটে চলে পুরুলিয়ার দিকে। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অপরূপা বাংলার স্বাদ নিতে নিতে অবশেষে ফুটিয়ারির কোলে। আকাশে তখন মেঘের আস্তরণ বেড়েই চলেছে। তালগাছগুলি আরও দৃপ্ত পদচ্ছাপ রেখে দেওয়ার প্রস্তুতিতে, ফুটিয়ারির জলে ধীরে ধীরে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ বয়ে চলেছে।

ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ বয়ে চলেছে।

অপর দিকে তিলাবনি আর প্যাঞ্জোনিয়া ক্রমেই স্নানের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে, মাঝে আমি বুনে চলেছি স্বপ্নের বাসভবন।  আহা! এর মাঝে যদি হত আমার স্বপ্নকুটির। মোহাচ্ছন্নতা কাটালেন দিব্যেন্দুদা – “আরে দাদা, দেশি মুরগির ঝোল রেডি, গরম গরম দু’টো ভাত পেটে দিয়ে আবার নিজের স্বপ্নকুঁড়ি ফোটান।”

ডাল, বেগুনভাজা আর গরম মুরগির ঝোল দিয়ে সপাসপ মেরে এ বার সারপেন্টাইল রাস্তা ধরে হন্টন। কী অপরূপ ল্যান্ডস্কেপ বলে বোঝানো যাবে না। সবুজের বুক চিরে লালমাটির চোখরাঙানি, তাল-পলাশ-কুসুম-মহুয়াদের সদর্প অধিষ্ঠান, তিলাবনিদের বিশ্বস্ত সঙ্গ, ড্যামের রাস্তা ধরে স্থানীয়দের সাইক্লিং – সবে মিলে শোণিতধারা পালটে দেওয়ার সব উপকরণ হাজির।

মেঘ আরও জমে আসছে, কালো আকাশের নীচে ফুটিয়ারি যেন আরও অভিমানী। উষ্ণতার পারদ ক্রমেই নিম্নমুখী, গায়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আয়োজন, বাতাসে লালমাটির ভেজা গন্ধ, কাশঝোপে মেটাক্রোনাল তরঙ্গ…। এ আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? বৃষ্টির তেজ বাড়তে অগত্যা টেন্টে ফেরা।

শাপলার সমারোহ।

ফুটিয়ারি রিট্রিট দিব্যেন্দুদার স্বপ্নের প্রজেক্ট। আগে তাজপুর রিট্রিট বানিয়েছিলেন, তার পর এই ফুটিয়ারি প্রজেক্ট।  আপাতত একটি ডিলাক্স কটেজ আর চারটি টেন্ট। বাথরুম থেকে বেডরুম –  সবেতেই সুরুচিসম্মত মননের ছাপ। ফুটিয়ারির পাশে হওয়া এই ফুটিয়ারি রিট্রিট অবস্থান মাহাত্ম্যে বেশ মনোমুগ্ধকর। আপাতত এসি না থাকলেও ধীরে সে ব্যবস্থাও হবে। সবে তো পথচলা শুরু হয়েছে।

রক ক্লাইম্বিং থেকে জিপ লাইনিং, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের বহু ক্রিয়াকলাপ আগামী বছর থেকে শুরু হয়ে যাবে প্রায় ১৪ বিঘার বিশাল প্রজেক্টে। তবে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস শুরু হওয়ার আগের ফুটিয়ারি রিট্রিট দেখে আমি মুগ্ধ।  বাকিগুলি শুরু হলে হয়তো ট্যুরিজমের এক অন্য দিক খুলে যাবে। কায়াকিংও শুরু হয়ে যাবে এই বছরের শেষ দিক থেকে।

রাত জেগে ড্যামের ধারে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আরামকেদারায় বসে শুধু ভাবছিলাম এই বাংলাকে ঠিক কতটা চিনেছি আমরা। কত অদেখা জায়গা শুধু এই বাংলাতেই। বিশেষ করে এই পুরুলিয়ার কত জায়গা অনাঘ্রাত থেকে গিয়েছে আমাদের কাছে।

ভোর হতেই গাড়ির চাকা ছুটে চলে তিলাবনি, প্যাঞ্জোনিয়া আর সিন্দুরপুরের দিকে। পথের শোভা ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব। মাত্র ১০-১২ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে এ এক স্বপ্নভূমিই বটে। তিনটে পাহাড়ই আবহবিকারের ফলে ভগ্নপ্রায় অবস্থায়। পাহাড় ভেঙে বড়ো বড়ো বোল্ডার গা বেয়ে নেমে আসছে।  দাবার ছকে যেন বোল্ডারের গুটি সাজানো। পাহাড়ের নিচু ঢালের পাশ থেকে বয়ে চলেছে পিচঢালা কালো রাস্তার ঢেউ। মনে এসে গেল সেই পঞ্চমদার সুরে গানের দৃশ্যায়ণ – ‘পান্না কি তমান্না হ্যায় কি হিরা মুঝে মিল যায়ে’ – হ্যাঁ, একদম সেই স্পট।

পাহাড়ের নিচু ঢালের পাশ থেকে বয়ে চলেছে পিচঢালা কালো রাস্তার ঢেউ।

তিন পাহাড়ের সান্নিধ্যলাভের পর চললাম দ্বারকেশ্বর নদীর উৎপত্তিস্থল দেখতে। সুন্দর ল্যান্ডস্কেপকে পাশে রেখে দুর্গাসিংডাঙায় পৌঁছে তো অবাক। প্রস্রবণের জলধারা সরু হয়ে বয়ে চলেছে ক্যানিয়ন বেয়ে। ভাবা যায়, এই দ্বারকেশ্বরই ‘বাঁকুড়ার দুঃখ’-এর রূপ নেয় বছরে বছরে।

পরের গন্তব্য পাকবিড়রা ভৈরবস্থান। কষ্টিপাথরের এক অদ্ভুত শৈলী যে এই বাংলায় আছে জানতামও না, দিব্যেন্দুদা না বললে। সময় কম। তাই এর পর কাশীপুর রাজবাড়ি দেখে আবার ফিরে আসতে হল।

তবে এই ফুটিয়ারি রিট্রিট-এ থেকে আপনি ঘুরে নিতে পারেন অচেনা, অনাঘ্রাত পুরুলিয়ার বেশ কিছু অংশ। এ ছাড়া চেনা পুরুলিয়া তো আছেই –  আপার ড্যাম, লোয়ার ড্যাম,  বামনি ফলস, চড়িদা, পাখিপাহাড় ইত্যাদি ইত্যাদি।

কী ভাবে যাবেন

(১) যদি গাড়ি নিয়ে যান

কলকাতা থেকে দূরত্ব প্রায় ২৮০ কিমি, সময় লাগবে প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। পথ: কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পানাগড়, টোল প্লাজা পেরিয়ে দুর্গাপুরের কাছে বাঁ দিকে বাঁকুড়ার পথ ধরুন। বাঁকুড়ার ধলডাঙা মোড় থেকে ডান দিকে পুরুলিয়ার পথ ধরুন (জাতীয় সড়ক ৬০এ)। ৬ কিমি মতো গিয়ে পুয়াবাগান মোড় থেকে ডান দিকে চলুন হুরা। ওই পথে আরও ১৫ কিমি গিয়ে লধুড়কা মোড়। সেখান থেকে ডান দিকে চলুন শালডিহা মোড় (৩ কিমি)। সেখান থেকে বাঁ দিকে ২ কিমি ফুটিয়ারি রিট্রিট।

(২) যদি ট্রেনে যান

হাওড়া থেকে ট্রেনে আদ্রা বা পুরুলিয়ায় গিয়ে সেখান থেকে গাড়িতে ফুটিয়ারি। দূরত্ব ২৭-২৮ কিমি।  

থাকার সুব্যবস্থা।

কোথায় থাকবেন

থাকবেন ফুটিয়ারি রিট্রিট-এ। যোগাযোগ : দিব্যেন্দু ঘোষ  (+৯১৯০৫১১৬৬৫৬৩)  

খরচ: ডিলাক্স কটেজ – প্রতি দিন মাথাপিছু ১৬০০ টাকা (যদি দু’ জন থাকেন)/১৪০০ টাকা (যদি তিন বা চার জন থাকেন)।

টেন্ট – প্রতি দিন মাথাপিছু ১৪০০ টাকা (যদি দু’ জন থাকেন)/১২০০ টাকা (যদি তিন জন থাকেন)।

খরচ থাকা এবং খাওয়া-সহ।

ঘোরাঘুরি

ফুটিয়ারি থেকে অফবিট পুরুলিয়া ঘুরে দেখতে বোলেরো গাড়িতে খরচ হবে ২৫০০-২৮০০ টাকা।

ভ্রমণঅনলাইনে আরও পড়তে পারেন

চেনা বৃত্তের বাইরে: তামিলনাড়ুর শৈলশহর ভালপারাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *