মেঘ পিওনের পাটনিটপ

avijit kumar chatterjee
অভিজিৎ কুমার চ্যাটার্জি

‘…আমার দিকে কেন তাকায়, তোমার চোখ,/লিখতে কেন বাধ্য করে এই অবেলায়,/দ্বিধান্বিত সুখ! সেও তো এক মনের অসুখ…’।

পাইনের বুক চিরে যখন সূর্য উঁকি দিল, তখন একদল মেঘ উড়ে গেল নির্জন রাস্তা দিয়ে। ৬৫০০ ফুট উঁচু এই হিল স্টেশনে মেঘ ঘুরে বেড়ায় আনমনে, এক সময়ে এই গ্রামের নাম ছিল ‘পাটান দা তালাও’, মানে রাজকুমারীর পুকুর। স্থানীয়রা মনে করেন এখানেই নাকি রাজকুমারী স্নান করতেন। ইংরেজদের ভুল উচ্চারণ ক্রমে এই জায়গার নাম হয় ‘পাটনিটপ’। আজ তালাওয়ের সেই রূপ অবশ্য আর নেই!

sunrise at patnitop
পাটনিটপে সূর্যোদয়।

এখানে সকালটা শুরু হয় মেঘের চাদর গায়ে দিয়ে আর বিকেলটা কাটে রঙিন মেঘেদের সঙ্গে গল্প করে। ভোরে সূর্য্যিমামা ওঠার আগেই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা মেঘের দল প্রস্তুতি নিতে শুরু করে জেগে ওঠার। এক সময় আড়মোড়া ভেঙে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকে কুয়াশার মতো। তখন এক হাত দূরের জিনিসও ঝাপসা হয়ে ওঠে। মুখ তুলে উঁচু গাছটির দিকে তাকালে দেখা যায় পথ ভুলে আটকে গিয়েছে এক টুকরো সাদা মেঘ। সেই সাজানোগোছানো মেঘ-বিছানো রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে নিজেকে মনে হয় মেঘের রাজ্যের অতিথি।

ভোরবেলা জানলা খুলতেই স্নিগ্ধ বাতাস মনকে ছুঁয়ে গেল, আর কানে কানে বলে গেল ‘দূরে কোথায়..দূরে দূরে’। প্রকৃতি যেন আজ তার রং-রূপ, স্নিগ্ধতা সব উজাড় করে দিয়েছে। মন-ভালো-করা সকাল মুহূর্তে সতেজ করে দিল। আকাশের স্বচ্ছ নীল রং, পাখির ডাক, ফুলের গন্ধ – ভরে উঠল মন-ভালো-করা আজকের সকাল।

solitary patnitop
পাটনিটপের নির্জনতা।

চার দিকে পাইন দেবদারুর জঙ্গল, মাঝখানে রাস্তা, হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি চিনে নিলে মেঘ পিওন পৌঁছে দেবে মেঘ মিনারে। চন্দ্রভাগার অববাহিকায় রূপসী পাটনিটপ আড়মোড়া ভাঙে মেঘেদের খামখেয়ালি দস্যিপনায়। শরীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকে কাঁচা হলুদ রোদ।

শীতকালে পুরু বরফে ঢেকে যায় গোটা এলাকা। শীতের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস নিয়ে জমে ওঠে পাটনিটপ। অন্য সময় পাটনিটপে চলে মেঘ-রোদ্দুরের ‘লুকোচুরি স্পোর্টস’!

পাহাড়ের মাথায় পাটনিটপ। একটু হেঁটে গেলে নাগদেবতার মন্দির, দেখার বলতে ওই মন্দিরটুকুই! আর বাকিটা হারিয়ে যাওয়া মেঘ পিওনের হাত ধরে, কিংবা স্মৃতির মেদুরতার আঁচলে মুখ ঢাকা। কথিত আছে, এখানে মানত করে দড়ি বেঁধে রেখে গেলে মানত পূর্ণ হবেই হবে। আর মানত পূর্ণ হলে আপনাকে এসে খুলে দিয়ে যেতে হবে আপনার বাঁধা দাগা! স্থানীয়দের কাছে বেশ জনপ্রিয় তীর্থস্থান এটি।

দুপুরে রিসর্ট একটু বিশ্রাম, বিকেলটা যে এখনও বাকি আছে!

gaddis of patnitop
পাটনিটপের গদ্দিরা।

বিকালের আলো রেণু রেণু উড়ে বেড়ায় গোটা পাটনিটপ জুড়ে। জলতরঙ্গের আওয়াজ তখন সারা আকাশ জুড়ে। বিবাগি মেঘেদের মতো আমি আর নির্জন পাইন দেবদারুরা আকাশের ভিতর থেকে বুকফাটা মল্লার শুনি সারেঙ্গীর ছড়ে!

জম্মু শ্রীনগর হাইওয়ে (জাতীয় সড়ক ১এ) ধরে এগোলে জম্মু থেকে মাত্র ১১৩ কিমি দূরে পাটনিটপ। জম্মু ছাড়ালেই পিরপাঞ্জালের পাহাড়ি রাস্তা ও গোটা চারেক সুড়ঙ্গ পেরিয়ে উধমপুর। উধমপুর পর্যন্ত রাস্তা চার লেনের। জম্মু ছাড়িয়ে এগোলেই আপনাকে তাওয়াই ও জগতি নদীর উপর দিয়ে এগোতে হবে।

বছরের প্রধান চারটি মরশুমে পাটনিটপ সেজে ওঠে এক এক রূপে – বসন্তে ফুলের রঙে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে গোটা পাহাড়, গ্রীষ্মে সবুজের ফাগুন আর শরতে ঘাসেদের গায়ে লাগে সোনা-হলুদের আগুন, শীতে পাটনিটপ হয়ে যায় পুরো সাদা, ঢেকে যায় বরফের চাদরে।

bugiyal
বুগিয়াল।

সকালে ব্রেকফাস্ট করে চলুন ‘নাথা টপ’, পাটনিটপ থেকে মাত্র ১৪ কিমি। শীতকালে সারা নাথা টপ ধরে চলে স্কি-উৎসব, প্যারাগ্লাইডিং, স্লেজে চড়া ও টাট্টু ঘোড়ার পিঠে করে ঘুরে বেড়ানো। আপনি এসে পৌঁছোলেই ঘিরে ধরবে সরল মানুষগুলো। গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে দেখে নিন আকাশজোড়া বরফাবৃত পাহাড়। বাতাসে বেশ ঠান্ডার আমেজ আর চোখের সামনে দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা। মন-পেয়ালায় সেঁকে নিন একটু নিজেকে। জানেন তো, নৈঃশব্দ্যের মতো আর কোনো শব্দ নেই। পাহাড়ে এই ছম ছম করা নৈঃশব্দ্য সত্যিই মাইক্রোফোনের শব্দের চেয়েও বেশি ব্যাপ্ত। এই কথামালা কোনো সহজপাঠে লেখা নেই। এই নৈঃশব্দ্য হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। এদের যে ধরতে পারল সে পারল, আর যে পারল না, সে কোনো দিন ও পারবে না! আমি প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ নই, হওয়ার বাসনাও নেই, অল্প জানাতেই আমি খুশি। সবুজের উপত্যকায় হলুদরঙা প্রজাপতিদের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমি সকালের কিশোর হয়ে যাই। এই তো দারুণ আনন্দ, পরম সুখ।

আরও পড়ুন: পাথরের স্বপ্ন .. হালেবিদু ও বেলুর

ড্রাইভার বলে ওঠে, “বাবুজি চলিয়ে, আগে ভি তো দেখনা হ্যায়।”

সম্বিৎ ফেরে আমার। গাড়িতে এসে বসি। ঠান্ডাটা বেশ মালুম হচ্ছে। গাড়ি এগিয়ে চলে ‘সানাসার’, নাথা টপ থেকে ১০ কিমি। উচ্চতা ৮৫০০ ফুট। গাড়ি থেকে নেমেই মুখ থেকে প্রথম যে শব্দটা বেরিয়ে এল তা হল, আ! সত্যি চোখ জুড়িয়ে গেল, সবুজের তৃণভূমি ও পাহাড়ের দল, মাথায় তাদের বরফের চাদর আর সামনে একটা ছোট্টো ‘সানাসার’ লেক।

আত্মহারা মন হঠাৎ বলে ওঠে..

‘..যদি চেনা টানে মন ছোটে,/তবে দাও গেঁথে, এ বেলায়, অদেখা বাঁধন,/ছুঁয়ে যাওয়ারই অনুরোধে, করো না বারন..’।

sanasar lake
সানাসর লেক।

সবুজ ঘাসে ভরা ভারী সুন্দর উপত্যকার মধ্যে লাল-হলুদ-নীল অ্যালপাইন ফুল। অনাঘ্রাতা ঘাসফুলের ঘ্রাণ নিলাম প্রাণ খুলে। মনে হল বিরতিহীন গান শুনি, একান্ত কারও কাঁধে মাথা রেখে। বর্ণালি ভ্রমণে ইয়ারফোনের দু’টো তার দুলতে থাকুক দু’টো মানুষের কানে। একটা দলছুট বিহঙ্গ যখন জীবনের সমস্ত সম্ভাবনাময় মুহূর্তগুলোকে অতিবাহিত করে পৌঁছেছে জীবন সায়াহ্নে, জীবনখাতার প্রতিটি পাতা উলটিয়ে দেখেছে, কোথাও তার জীবনের সামান্যতম পরিপূর্ণতা সে পায়নি! আজ যখন সবুজের হাওয়া এসে তার মনের পর্দাটাকে করছে উন্মোচিত, মনটাকে বার করে নিয়ে যাচ্ছে এক নিরালা নির্জন জগতে, যেখানে শুধু চোখের স্বপ্নে ভরা মেঘ, সারা আকাশটাকে আবৃত করে রাখছে। এমন দিনে সে দু’ ফোঁটা অশ্রুর মাঝে নিজেকে ভাসাতে চাইবেই। মনের আকাশের কালো মেঘ থেকে ঝরে পড়বে কিছু বারিবিন্দু!

আরও পড়ুন: এক টুকরো হাম্পি : দেখুন জেনানা এনক্লোজার

হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজম চত্বরে। পাইন গাছেদের শান্তির সুনিবিড় মিছিল যেন! বসার জন্য রয়েছে বেঞ্চ। একটু বসি, কানে আসে হাওয়ার শনশনানি শব্দ আর পাখিদের গান, বেপরোয়া মন আর অপলক দৃষ্টি, আকাশ যুগান্তরের হোলি খেলার প্রস্তুতি শুরু করছে, ফুলেরা নিজেদের অঙ্গীকার ভুলে অবয়বের ছবি আঁকায় শামিল তখন।

মনে পড়ে গেল, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ চলচিত্রে, ছবি বিশ্বাস মহাশয় বলেছিলেন, ‘.. I live because I exist,I cherish it and I am proud of it..’

বাউন্ডুলে মন জীবনমৃত্যুর দোদুল্যতায় বুঝে নিতে চায় জীবনের হিসাবনিকাশ। দূরাগত কুজনে ছিন্ন হয় মায়ার বাঁধন, মেলে দেয় নীল ডানা।

jktdc cottage at sanasar
সানাসরে জম্মু-কাশ্মীর পর্যটনের কটেজ।
কী ভাবে যাবেন

ভারতের প্রায় সব বড়ো শহরের সঙ্গে জম্মু তাওয়াই ট্রেনপথে যুক্ত। কলকাতা থেকে যাওয়ার জন্য রয়েছে জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস (কলকাতা স্টেশন, রোজ), হিমগিরি এক্সপ্রেস (হাওড়া থেকে সপ্তাহে তিন দিন) এবং সাপ্তাহিক সুবিধা এক্সপ্রেস (হাওড়া থেকে)। দিল্লিতে ট্রেন বদল করেও যাওয়া যায়। দিল্লি থেকে জম্মু যাওয়ার অনেক ট্রেন। দিল্লি থেকে ট্রেনে উধমপুরও চলে যেতে পারেন। ট্রেনের সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in

বিমানে দিল্লি গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে বা বিমানে জম্মু যেতে পারেন।

জম্মু থেকে পাটনিটপ ১১৩ কিমি, বাসে বা গাড়িতে আসতে পারেন। উধমপুর থেকেও বাস বা গাড়িতে আসতে পারেন পাটনিটপ, দূরত্ব ৫০ কিমি

কোথায় থাকবেন

পাটনিটপে থাকার জন্য রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর পর্যটনের কটেজ। অনলাইন বুকিং www.jktdc.co.in, যদিও তাঁদের ব্যবস্থাপনায় কোথায় যেন একটু খামতি রয়েছে। থাকার জন্য পাটনিটপে অনেকগুলি প্রাইভেট হোটেল রয়েছে, যাদের মধ্যে অবস্থানগত কারণে ‘হেটেল স্যামসন’, ‘পাটনিটপ হাইটস’, ‘হোটেল গ্রিন টপ’ ভালো। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে, অনলাইন বুকিং ব্যবস্থাও আছে।

আরও পড়ুন: চলুন মমতাজমহলের স্মৃতি বিজড়িত শাহি হাম্মামের শহরে

সানাসারে থাকার জন্য রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর পর্যটনের কটেজ একদম লেকের ধারে। অনলাইন বুকিং www.jktdc.co.in । আর যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য রয়েছে প্রাইভেট মালিকাধীন তাঁবুর ব্যবস্থা (যোগাযোগ করুন: ‘শেরপা অ্যাডভেঞ্চার’, দলবিন্দর সিং, যোগাযোগ ৯৬২২৬৮৮৮৮, ৯৮৫৮১৯৯১৩০)

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য

জম্মু থেকে পাটনিটপ যাওয়ার পথে পড়বে মানসর লেক। জম্মুর স্থানীয়দের কাছে প্রিয় একটি পিকনিক স্পট। চারি দিকে পাহাড় আর তার মাঝে নীল টলটলে জলের একটি লেক। ভারী মনোরম পরিবেশ। বাবা মানসর শেষনাগের এক অবতার। কথিত আছে উনি এখানেই ধ্যান করেন, রয়েছে তাঁর মন্দিরও। লেকের জলে রয়েছে প্রচুর মাছ, তাঁদেরও দেবতা হিসাবে মানা হয়। ইচ্ছে করলে লেকে বোটিংও করতে পারেন।

পাটনিটপ থেকে ৭ কিমি দূরে কুদ। এখানকার খাঁটি ঘিয়ে তৈরি শোনপাপড়ি অবশ্যই চেখে দেখবেন। জায়গাটি সারা জম্মুতে বিখ্যাত হয়ে রয়েছে শোনপাপড়ি, চকোলেট, কালাকাঁদের জন্য। স্থানীয়রা বলেন ‘পাটিসা চকলেট’। ‘প্রেম কাট্টি’ দোকানটি একটি ব্র্যান্ড হয়ে রয়েছে সারা জম্মুতে।

গাড়ি: বলবীর সিং ( যোগাযোগ ৯৭৯৭৫৯৮৪৭৪)

ছবি: লেখক ও সংগৃহীত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *