চেনা বৃত্তের বাইরে: তামিলনাড়ুর শৈলশহর ভালপারাই

ভ্রমণঅনলাইন ডেস্ক: তামিলনাড়ুর শৈলশহর বলতেই চোখের সামনে ভাসে উটি, কোদাইকানাল, ইয়েরকাড বা খুব বেশি হলে ইয়েলাগিরি, যাকে সবাই ‘গরিবের উটি’ বলে ডাকে। অপার নৈসর্গিক শোভা নিয়ে চোখের আড়ালেই পড়ে থাকে ভালপারাই, যার রূপ আরও খোলে বর্ষায়, মানে তামিলনাড়ুর বর্ষায় অর্থাৎ ফিরতি মৌসুমি বায়ুর সময়ে অক্টোবর-নভেম্বরে।

তা হলে চলুন আজ যাওয়া যাক ভালপারাই।

পথের রোমাঞ্চ

সমতলের পোল্লাচি থেকে পাহাড়শীর্ষের ভালপারাই পর্যন্ত সড়কপথটি রোমাঞ্চয় ভরা। চুলের কাঁটার মতো ৪০টি বাঁক আছে এই পথে। এই বাঁক ঘুরে ঘুরে রাস্তা উঠেছে ক্রমশ উপরে। এই পথে বন্যজন্তুর দেখা পাওয়া খুব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। হাতি চলাচলের পথ এটি। এই অঞ্চলে প্রচুর চিতাবাঘও আছে। আর ভালপারাই রেঞ্জ তো বিরল প্রজাতির নীলগিরি থরের আবাসভূমি। তাই এই পথের টানেই চলুন ভালপারাই।

পোল্লাচি থেকে ভালপারাইয়ের পথ।

উপভোগ করুন

তামিলনাড়ুর কোয়ম্বত্তুর জেলার ভালপারাই পর্যটকদের নজরের আড়ালে পড়ে থাকা এক অনিন্দ্যসুন্দর শৈলশহর। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার আনামালাই গিরিশ্রেণিতে অবস্থিত ভালপারাই। চা-বাগান আর কফি-বাগিচাকে ঘিরে রাখা সবুজ পাহাড়শ্রেণি, জঙ্গল আর ঝরনা – এই নিয়ে ভালপারাই। চেরাপুঞ্জির পরেই ভারতের আর যে সব খুব বেশি বৃষ্টিপাতের জায়গা রয়েছে তার মধ্যে এই ভালপারাইয়ের চিন্না কল্লার অন্যতম। তামিলনাড়ু ভ্রমণে গিয়ে ভালপারাইয়ে দু’-তিনটে দিন কাটিয়ে আসা যেতেই পারে। আশেপাশের দ্রষ্টব্য দেখে আসুন, পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করুন, চা-বাগান আর কফি-বাগিচার সঙ্গে মিতালি করুন, কিংবা অনাবিল প্রকৃতির দৃশ্য উপভোগ করতে করতে দু’টো দিন নিখাদ বিশ্রাম করুন।

ভালপারাইয়ের আশেপাশে

(১) কুলাঙ্গাল নদী – শহর থেকে ৩-৫ কিমি।

কুলাঙ্গাল নদী।

(২) চিট্টি বিনয়গর মন্দির – শহর থেকে ৫ কিমি, সুন্দর বাগানের মধ্যে।

(৩) নিরার ড্যাম – শহর থেকে ১০ কিমি দূরে জঙ্গলের মধ্যে এই ড্যাম। এই নিরার ড্যাম থেকে শোলেয়ার ড্যাম পর্যন্ত একটি টানেল আছে।

(৪) বালাজি মন্দির – শহর থেকে ১০ কিমি দূরে, পেরিয়া কারামালাই টি এসটেটের মধ্যে। মন্দিরের পরিবেশটি ভারী সুন্দর। শেষ ৫০০ মিটার চড়াই ভেঙে হেঁটে উঠতে হয়।

কারামালাই আন্নাই বেলানকান্নি চার্চ।

(৫) কারামালাই আন্নাই বেলানকান্নি চার্চ – শহর থেকে ১০ কিমি দূরে চা বাগানের মাঝে, বালাজি মন্দির যাওয়ার পথে। উলটো দিকেই একটি ঝরনা। নৈসর্গিক দৃশ্যের কোনো তুলনা হয় না।

(৬) গ্রাস হিলস – ইন্দিরা গান্ধী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের অংশ। পাহাড়ের গায়ে বড়ো বড়ো সবুজ ঘাসের জঙ্গল। নীলগিরি থরের বিচরণভূমি। হেঁটে বেড়ানোর পক্ষে আদর্শ জায়গা। শহর থেকে ১৫ কিমি।       

(৭) আপার শোলেয়ার ড্যাম – শহর থেকে ১৫ কিমি। জনপ্রিয় পিকনিক স্পট।     

নাল্লামুড়ি ভিউ পয়েন্ট

(৮) নাল্লামুড়ি ভিউ পয়েন্ট – ভালপারাই শহর থেকে ১৫ কিমি, শেষ ১ কিমি চা-বাগানের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়। এখানে ঢোকার জন্য দর্শনী দিতে হয়।

(৯) মনমপল্লি ফরেস্ট – দুরন্ত বেগে ছুটে চলা নদী, ঘন শোলার জঙ্গল আর অনাবিল প্রকৃতির সৌন্দর্য – এই নিয়ে মনমপল্লি ফরেস্ট। শহর থেকে ১৮ কিমি। 

(১০) চিন্না কল্লার – ‘তামিলনাড়ুর চেরাপুঞ্জি’ নামে অভিহিত চিন্না কল্লার ভালপারাই শহর থেকে ২৫ কিমি দূরে। ঘন সবুজ বন। তারই মধ্যে জলপ্রপাত, ঝুলন্ত সেতু এবং বন্যপ্রাণী। দর্শনী দিয়ে ঢুকতে হয়। হাতির দেখা মিলতে পারে বলে ঢোকার মুখে বনকর্মীরা সতর্ক করে দেন।

চিন্না কল্লার।

(১১) লোম্স ভিউ পয়েন্ট – পোল্লাচি থেকে ভালপারাই আসার পথে ৯ নম্বর হেয়ারপিন বাঁকের কাছে। এখানে নীলগিরি থর দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভালপারাই থেকে এই জায়গাটির দূরত্ব ৩০ কিমি।

(১২) মাঙ্কি ফলস্‌ – শহর থেকে ৩৭ কিমি দূরে, পোল্লাচি যাওয়ার পথে।

(১৩) আলিয়ার ড্যাম – পোল্লাচি যাওয়ার পথে শহর থেকে ৪১ কিমি। পাহাড়ের গায়ে। কাছেই রয়েছে তামিলনাড়ু ফিশারিজ কর্পোরেশন পরিচালিত অ্যাকোয়ারিয়াম ও নয়নাভিরাম থিম পার্ক।

আলিয়ার ড্যামে পার্ক।

(১৪) ইন্দিরা গান্ধী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য – আনামালাই পাহাড়ে এই অভয়ারণ্যের প্রবেশদ্বার টপ স্লিপে, ভালপারাই থেকে ৬৭ কিমি। হাতি, লায়ন-টেলড্‌ ম্যাকাও, বার্কিং ডিয়ার, বুনো শুয়োর, লাঙ্গুর, নীলগিরি লাঙ্গুর প্রভৃতি বন্যপ্রাণীর দর্শন মিলতে পারে। পক্ষীকুলেরও স্বর্গরাজ্য এই অভয়ারণ্য। কালো ঠোঁটের ময়না, গ্রেট হর্নবিল, মালাবার পিড হর্নবিল, গ্রে মালাবার হর্নবিল, ওয়েনাড় লাফিংথ্রাশ ইত্যাদি নিয়মিত দেখা যায়।

(১৫) আথিরাপল্লি ও ভাজাচল জলপ্রপাত – ভালপারাই থেকে কেরলের চালাকুড়ি যাওয়ার রাস্তায় আথিরাপল্লি জলপ্রপাত, দূরত্ব ৭৬ কিমি। আথিরাপল্লি থেকে ৫ কিমি দূরে ভাজাচল। ভাজাচল থেকে ভালপারাই ৭১ কিমি।          

কী ভাবে যাবেন

(১) ট্রেনপথে – তামিলনাড়ুর ভালপারাইয়ের সব চেয়ে কাছের রেলস্টেশন পোল্লাচি। চেন্নাই থেকে পোল্লাচি যাওয়ার একমাত্র ট্রেন পালাক্কাড় এক্সপ্রস। চেন্নাই সেন্ট্রাল থেকে রাত ৯.৪০ মিনিটে ছেড়ে পোল্লাচি পৌঁছোয় পরের দিন সকাল ৮.৫০ মিনিটে। পোল্লাচি থেকে ভালপারাই ৬৪ কিমি। নিয়মিত বাস চলে পোল্লাচি থেকে ভালপারাই। গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন।

পোল্লাচি সব চেয়ে কাছের স্টেশন হলেও অনেক বেশি ট্রেন থাকার জন্য কোয়ম্বত্তুর বা পালাক্কাড় (আগেকার পালঘাট) হয়েও যেতে পারেন ভালপারাই।  

কলকাতা থেকে কোয়ম্বত্তুর বা পালাক্কাড় সরাসরি যাওয়ার জন্য ৬টি ট্রেন আছে। তার মধ্যে ১টি দ্বি-সাপ্তাহিক, বাকি ৫টি সাপ্তাহিক। দ্বি-সাপ্তাহিক ট্রেনটি শালিমার-তিরুঅনন্তপুরম এক্সপ্রেস – শালিমার থেকে মঙ্গলবার ও রবিবার ছাড়ে রাত ১১.০৫ মিনিটে, কোয়ম্বত্তুর ও পালাক্কাড় পৌঁছোয় যথাক্রমে বৃহস্পতিবার ও মঙ্গলবার সকাল ১১.৫৭ এবং দুপুর ০১.০৭ মিনিটে।

পোল্লাচি- ভালপারাই পথে লোম্স‌ ভিউ পয়েন্ট।

কলকাতা থেকে ট্রেনের স্বল্পতার জন্য চেন্নাইয়ে ট্রেন বদল করেও যেতে পারেন।  

চেন্নাই থেকে কোয়ম্বত্তুর বা পালাক্কাড় যাওয়ার প্রচুর ট্রেন আছে। ট্রেন বিশেষে কোয়ম্বত্তুর যেতে ৭ থেকে সাড়ে ৯ ঘণ্টা সময় লাগে। কোয়ম্বত্তুর থেকে ট্রেনে পালাক্কাড় যেতে আরও ঘণ্টা খানেক সময় লাগে।

ট্রেনের বিস্তারিত সময়ের জন্য দেখে নিন erail.in।

কোয়ম্বত্তুর থেকে ভালপারাই ১০৮ কিমি। পালাক্কাড় থেকে ভালপারাই ১১১ কিমি। দু’টি পথই পোল্লাচি হয়ে গিয়েছে। কোয়ম্বত্তুর বা পালাক্কাড় থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলুন ভালপারাই। কোয়ম্বত্তুর থেকে বাসও পাবেন ভালপারাই যাওয়ার জন্য। 

(২) বিমানপথে – বিমানে চলুন কোচিন। সেখান থেকে সড়কপথে ভালপারাই ১৪৯ কিমি, গাড়ি ভাড়া করে চলুন।

ভালপারাইয়ে এই দৃশ্য আকছারই দেখা যায়।

কোথায় থাকবেন

ভালপারাইতে থাকার জন্য নানা মানের, নানা দামের বেসরকারি হোটেল, রিসর্ট, হোম স্টে, হলিডে হোম আছে। নেটে সন্ধান করলে পেয়ে যাবেন।

আরও পড়ুন: চেনাবৃত্তের বাইরে: পশ্চিমঘাটের কোলে সাওয়ন্তওয়াড়ী

মনে রাখুন

(১) ভালপারাইয়ের কিছু দ্রষ্টব্য বেসরকারি মালিকানাধীন চা-বাগানের ভেতরে। সে সব জায়গায় ঢুকতে হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাথাপিছু দর্শনী দিতে হয়।

(২) গ্রাস হিলস্‌ জায়গাটি বন দফতরের সংরক্ষিত অঞ্চল। এখানে ঢুকতে হলে পোল্লাচির আনামালাই টাইগার রিজার্ভ অফিস থেকে অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়।   

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *